মহামারি করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যাংকগুলো প্রণোদনার যে ঋণ বিতরণ করেছে, সেই ঋণ কোথায় গেছে, কারা নিয়েছে, তা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদি এই প্রণোদনার টাকা যাদের প্রয়োজন তারা না পেয়ে থাকেন, অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্তরা না পেয়ে অন্য কেউ পেয়ে থাকেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও ঋণগ্রহিতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো চিঠিতে কারা ঋণ নিয়েছে ও ঋণের ব্যবহার কোথায় হয়েছে, তার তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসার যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে ছোট ও বড় ব্যবসায়ীরা স্বল্প সুদে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ঋণ নিয়েছেন। এ ঋণের মোট সুদের অর্ধেক ভর্তুকি হিসেবে দিয়েছে সরকার। জনগণের করের টাকা থেকেই এ ভর্তুকি দেওয়া হয়।
ঋণ দেওয়ার প্রায় এক বছর পর বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ঋণের ব্যবহার খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য কারা ঋণ নিয়েছে ও ঋণের ব্যবহার কোথায় হয়েছে, তার তথ্য চাওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রাহক ঋণ নিয়েছে এমন তথ্য দেখিয়ে ব্যাংকগুলো সুদ ভর্তুকির টাকা নিয়ে গেছে। তাই প্রথমত দেখা হবে আসলেই গ্রাহকের কাছে ঋণ গেছে কি না। এরপর দেখা হবে ওই গ্রাহক ঋণের টাকার ব্যবহার কোথায় করেছেন। কারণ, ঋণের ব্যবহার হওয়ার কথা শুধু চলতি মূলধন হিসেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ব্যাংকগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তথ্য পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তা খতিয়ে দেখা হবে। ঋণের টাকা কারা পেল ও কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে গত বছর সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ঋণ বিতরণ করে ব্যাংকগুলো। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয় ৪ শতাংশ সুদে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। বাকি সুদ ভর্তুকি হিসেবে দিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিতে পড়েছে, এমন তথ্য দেখিয়ে সরকারের দেওয়া প্রণোদনা তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ নিয়ে অনেকেই ভিন্ন খাতে খরচ করেছেন। কেউ কেউ ক্ষতি পোষাতে সরকারি তহবিলের ঋণ নিয়ে অন্য ব্যাংকের ঋণ শোধ করেছেন। কেউ আবার পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ‘আমাদের কাছে তথ্য আছে, করোনার কারণে ক্ষতিতে পড়েছে, এমন তথ্য দেখিয়ে সরকারের দেওয়া প্রণোদনা তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ নেয় দেশের একটি শিল্পগোষ্ঠী। ক্ষতি পোষাতে সরকারি তহবিলের ঋণ নিলেও শিল্পগোষ্ঠীটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন একটি ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ শোধ করে দেয় এ সময়ে।
‘আবার পোশাক খাতের একজন ব্যবসায়ীও ব্যবসার ক্ষতি পোষাতে প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ নিয়েছেন, একই সময়ে নতুন একটি কারখানাও কিনেছেন ওই ব্যবসায়ী। অন্য আরেকজন উদ্যোক্তা একদিকে নিয়েছেন স্বল্প সুদে ঋণ, অন্যদিকে নির্মাণ করছেন বিদ্যুৎ প্রকল্প। ঋণ নেওয়া ওই উদ্যোক্তা আবার শেয়ারবাজারেও বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন এই করোনাকালে। ফলে ক্ষতির মুখে পড়ে প্রণোদনার ঋণ নিলেও এসব বিনিয়োগের টাকা কোথা থেকে এল, সেটাই বড় প্রশ্ন।
‘এক বছর পর আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি, প্রণোদনার ঋণের টাকার যথাযথ ব্যবহার হয়নি। অনেকেই যে কারণে ঋণ নিয়েছিলেন, সে কাজে ব্যবহার করেছেন। আবার কেউ কেউ ভিন্ন খাতে টাকা খাটিয়েছেন।’
সে কারণেই প্রকৃত তথ্য জানতে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
চিঠিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বিতরণ করা ঋণের বিস্তারিত তথ্য ১৫ আগস্টের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে বলা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ২০২১-২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়ও প্রণোদনা ঋণের যথাযথ ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন গভর্নর ফজলে কবির।
তিনি বলেন, ‘এটা অনস্বীকার্য যে, মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিষয়টি আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চলমান করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে সরেজমিনে নিরীক্ষা কার্যক্রম অনেকটা শিথিল থাকায় প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর কিছু অপব্যবহারের বিষয়ে ইতোমধ্যে দেশের গণমাধ্যম ও বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।’
‘এ প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করতে চাই যে, বর্তমানে করোনার দুর্যোগময় পরিস্থিতির কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরেজমিনে পরিদশর্ন/নিরীক্ষা কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্থ হলেও প্রযুক্তিনির্ভর অফ-সাইট নিরীক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর টাকা যে উদ্দেশে ব্যবহারের জন্য দেয়া হয়েছে, তা যেন অন্য কোন উদ্দেশে ব্যবহৃত হতে না পারে, সে ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব নজরদারি বাড়িয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইতোমধ্যেই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
‘একইসঙ্গে, করোনা পরিস্থিতির কাঙ্খিত উন্নতির সাথে সাথেই প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর যথাযথ ব্যবহারের বিষয়ে সরেজমিনে নিরীক্ষা কার্যক্রম জোরদারকরণের পাশাপাশি এর ব্যবহার ও ফলাফল বিষয়ে বিশেষ সমীক্ষা পরিচালনার বিষয়টিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।’
এছাড়া আর্থিক খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং বিদেশে অর্থপাচার রোধকল্পে বিএফআইইউয়ের মাধ্যমে আর্থিক গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান ফজলে কবির।