ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) পাকিস্তানের পণ্যের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা ‘জিএসপি প্লাস’ প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ বয়ে এনেছে।
পাকিস্তান তাদের মোট রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশ রপ্তানি করে ২৮ জাতির জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নে।
ইইউ ছিল পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি বাজার। 'জিএসপি প্লাস' সুবিধা পাওয়ায় এই বাজারে সস্তায় পণ্য বিক্রি করতে পারত পাকিস্তান। 'জিএসপি' প্রত্যাহার করায় এখন দেশটিকে ইউরোপের বাজারে যেকোনো পণ্য রপ্তানি করতে হলে ২০ থেকে ২২ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এর ফলে পাকিস্তান আর সস্তায় পণ্য বিক্রি করতে পারবে না।
আর এই সুবিধাটিই বাংলাদেশ পাবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশের কয়েকটি খাতের রপ্তানিকারকরা। বিশেষ করে হোম টেক্সটাইল, টেরিটাওয়েল ও নিট পোশাক পণ্য রপ্তানিতে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে জানিয়েছেন তারা।
গত সোমবার ইইউ পার্লামেন্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিএসপি প্লাস বাণিজ্য সুবিধা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে পার্লামেন্টের সব সদস্যই একমত হয়েছেন।
বিতর্কিত ব্লাসফেমি আইনের কারণে গত এপ্রিলে পাকিস্তানের এই সুবিধা প্রত্যাহারের কথা ওঠে। তখন এ ব্যাপারে যৌথ একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। এ ব্যাপারে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর কথাও বলা হয়।
পাকিস্তানে ধর্মীয় অবমাননার শাস্তি দিতে করা ব্লাসফেমি আইন চালু করায় ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয় দেশটির সরকারকে। ফাইল ছবি
সোমবার এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে বলা হয়, পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে প্রায়ই। এ নিয়ে সেখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে।
ব্যাপক বন্যায় ফসলহানির পর ২০১৪ সালে পাকিস্তানকে মানবিক বিবেচনায় জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এরপর ইইউতে পাকিস্তানের রপ্তানি বেড়ে দ্বিগুণ হয়।
ইইউ এখন পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। জিএসপি প্লাসের আওতায় থাকা শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার হওয়ায় পাকিস্তানের বিভিন্ন পণ্যভেদে গড়ে ২০ থেকে ২২ শতাংশ হারে শুল্কারোপ হতে পারে। ফলে এত বেশি হারে আর রপ্তানি করতে পারবে না পাকিস্তান।
ইইউ পাকিস্তানের জিএসপি প্লাস সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়ায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরেই বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য হোম টেক্সটাইল রপ্তানি ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ হোম টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ।
ইইউ পাকিস্তানের জিএসপি প্লাস সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরেই বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য হোম টেক্সটাইল রপ্তানি ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। ছবি: নিউজবাংলা
বুধবার নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ইইউ পাকিস্তানের জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের জন্য খুবই সুবিধা হয়েছে। আমাদের হোম টেক্সটাইল সেক্টরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল পাকিস্তান।
‘একদিকে জিএসপি সুবিধা, অন্যদিকে গত কয়েক বছরে তারা তাদের মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়নের ফলে খুবই কম দামে হোম টেক্সটাইল পণ্য ইইউ বাজারে রপ্তানি করত। এখন আর সেটা পারবে না। ওই বাজারটাই আমাদের দখলে চলে আসবে।’
তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান তাদের মোট হোম টেক্সটাইল পণ্যের ৫০ শতাংশই রপ্তানি করত ইউরোপের বাজারে। এখন তারা ১৫-২০ শতাংশও পারবে না। সে হিসাবে আমার প্রত্যাশা ইইউর বাজারে আমাদের রপ্তানি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়বে।’
সব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল খাতের রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে হিসাব দিয়ে হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকা। এই দুই অঞ্চলই মহামারির প্রকোপ সামলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে।
‘এখন এসব দেশে বিছানার চাদর, বালিশ, বালিশের কাভার, টেবিল ক্লথ, পর্দা, ফ্লোর ম্যাট, কার্পেট, জিকজাক গালিচা, ফার্নিচারে ব্যবহার করা ফেব্রিকস, তোশক, পাপোশসহ অন্য হোম টেক্সটাইল পণ্যের চাহিদা বাড়বে। এই সুযোগটিই আমরা এখন কাজে লাগাতে চাই।’
পাকিস্তান ইউরোপের বাজারে যে নিট পোশাক রপ্তানি করত, তার একটা অংশ বাংলাদেশ দখল করতে পারব বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ হোম টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ। ছবি: নিউজবাংলা
হোম টেক্সটাইল পণ্যের পাশাপাশি টেরিটাওয়েল রপ্তানিও বাড়বে বলে জানান হারুন।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের মোট রপ্তানি আয়ের ৪৪ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২ শতাংশ। ওভেন পোশাকের চেয়ে আড়াই বিলিয়ন ডলার বেশি বিদেশি মুদ্রা এসেছে নিট খাত থেকে।
ইইউ পাকিস্তানের জিএসপি সুবিধা বাতিল করায় নিট খাতে কি প্রভাব পড়বে- এ প্রশ্নে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইইউর এই সিদ্ধান্তে আমাদের নিট পোশাক রপ্তানিতে কিছুটা সুবিধা তো আমরা পাবই। পাকিস্তান ইউরোপের বাজারে যে নিট পোশাক রপ্তানি করত, তার একটা অংশ আমরা দখল করতে পারব। আমাদের রপ্তানি বাড়বে।
‘তবে বড় সুবিধা পাবে আমাদের হোম টেক্সটাইল ও টেরিটাওয়েল। কারণ, এগুলোই পাকিস্তানের মূল রপ্তানি পণ্য।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি করে ১১৩ কোটি ২০ লাখ ৩০ হাজার (১.১৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৯ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। এর আগে কখনোই এ খাত থেকে এত বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসেনি; প্রবৃদ্ধিতে এমন উল্লম্ফনও হয়নি।
অন্যদিকে টেরিটাওয়েল রপ্তানি করে গত অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ডলার।