মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) অবদান ২৫ শতাংশ। অথচ, করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে এই খাতটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ মাসের প্রথম সপ্তাহে এসএমই ফাউন্ডেশনের এক জরিপে বলা হয়েছে, মহামারিতে দেশের ৮৩ শতাংশ ক্ষুদ্র শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন এ খাতের ৩৭ শতাংশ কর্মী।
জরিপে বলা হয়েছে, করোনার কারণে এ খাতের ব্যবসায়ীদের বিক্রি ৯৪ শতাংশ কমে গেছে। ৩৩ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।
২১ শতাংশ ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন এবং ১৬ শতাংশ বিকল্প উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছেন। মাত্র ৩ শতাংশের ব্যবসা আগের মতো চালু আছে। আয়-রোজগার না থাকায় ৬০ শতাংশ ছোট উদ্যোক্তা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয় জরিপ প্রতিবেদনে।
উদ্যোক্তরা বলছেন, এ খাতের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণে সরকারি প্রণোদনা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। তারা এসএমই খাতের জন্য আলাদা তহবিল গঠন করে কম সুদে ঋণ দেয়ার দাবি জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসএমই ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এসএমই খাত। এ খাত যাতে দ্রুততম সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সে জন্য ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে আমরা এ খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি। কিন্তু তফসিলি ব্যাংকগুলোকে এ বিষয়ে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।’
করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার।
এর মধ্যে এসএমই খাতের জন্য ২৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে, যা মোট প্রণোদনা তহবিলের মাত্র ১৮ শতাংশ। এসইএমই খাতের ক্ষতি পোষাতে এ খাতে কমপক্ষে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে এসএমই খাত প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। অথচ, এ খাতকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত, সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। এসএসএমই খাতের উন্নয়নে আলাদা একটি তহবিল গঠনের দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার টাকা পাওয়ার প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। এ খাতের প্রতি সরকারের আরও বেশি নজর দেয়া উচিত।
দেশে কত এসএমই রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে দুই বছর আগে করা ঢাকা চেম্বারের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে এসএমই শিল্প প্রায় ৫৪ হাজার। এ খাতে কর্মসংস্থানে জড়িত দুই থেকে আড়াই কোটি লোক। অপরদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, দেশে ৬০ লাখ এসএমই উদ্যোক্তা রয়েছেন। এর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নারী উদ্যোক্তা।
বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, ‘ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সংগঠিত নয়। ঋণ অনুমোদনে প্রয়োজনীয় কিছু ডকুমেন্ট লাগে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অত্যাবশ্যকীয় ডকুমেন্ট দিতে পারে না তারা। এ জন্য ঋণ সময়মতো মেলে না।
‘তবে ব্যাংকারদেরও দোষ আছে। বড় ব্যবসায়ীদের প্রতি তারা বেশি দুর্বল। এরও কারণ আছে। কম খরচে এক জায়গায় বেশি বিনিয়োগ করে তারা মুনাফা তুলে আনেন। বিপরীতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে খরচ বেশি, মুনাফা কম।’
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এসএমই উদ্যোক্তাদের ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়ার কথা রয়েছে। এ ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ। দুই বছরে ২৪ কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে খুব কমসংখ্যকই এ সুবিধা পেয়েছেন বলে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ।
প্রতিবছর ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন, এর মধ্যে মাত্র ২ থেকে ৪ লাখ চাকরি পাচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজন শ্রমঘন শিল্প স্থাপন। স্বল্প পুঁজিতে অধিকসংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে এসএমই খাতে। এ জন্য বেশি প্রণোদনা ও কর সুবিধা দিতে হবে এ খাতে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম বলেন, এসএমই খাতের সুবিধা হচ্ছে এখানে পুঁজি কম লাগে। বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, মাঝারি শিল্পে একজন লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রয়োজন হয় ৯৫ হাজার টাকা। ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য ৯৩ হাজার টাকা এবং কুটির শিল্পের জন্য প্রয়োজন ১০ হাজার টাকা।
টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন।
বর্তমান সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে রূপকল্প গ্রহণ করেছে। এতে এসএমই খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশিকা আছে। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ৪০ শতাংশ এসএমই খাতে দেয়ার কথা। এ ছাড়া ঋণের সীমা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ওই নির্দেশ প্রতিপালন করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।