সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় দেয়া ঋণ কেউ কেউ যথাযথ খাতে ব্যবহার না করে অনুৎপাদনশীল খাতেও ব্যবহার করছে বলে প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রণোদনা ঋণের টাকা নিয়ে ঋণগ্রহীতারা আগের ঋণের দায়ও পরিশোধ করছেন।
এ অবস্থায় প্রণোদনার ঋণ গ্রহীতারা ঋণ নিয়ে কী করছেন তা যথাযথ তদারকি করতে রোববার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ফের নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রতিটি ব্যাংককে নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ দ্বারা যাচাই করে ঋণের ব্যবহার বিষয়ে নিশ্চিত করতে হবে।
করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে গত বছর প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। প্রণোদনা প্যাকেজের সিংহভাগ ছিল স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ। সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে বিতরণ করা হচ্ছে প্রণোদনার ঋণ। সুদের অর্ধেক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার বেশি ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। কিন্তু কিছু গ্রাহক স্বল্প সুদের এ ঋণের যথাযথ ব্যবহার না করে নানা অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় প্রদত্ত ঋণের যথাযথ খাতে ব্যবহার না হয়ে কিছু ঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে যাচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রণোদনা ঋণের টাকা নিয়ে ঋণগ্রহীতারা আগের ঋণের দায় পরিশোধ করছে। ঋণের এমন অপব্যবহার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার সুস্পষ্ট পরিপন্থি।
এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে প্রণোদনার ঋণ বিতরণ খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। সামনে দ্বিতীয় দফায় ঋণ বিতরণ শুরু হবে, এ জন্য ব্যাংকগুলোকে আবারও সতর্ক করা হয়েছে। ঋণের ব্যবহার যাতে যথাযথ হয়, সেদিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে।
প্রণোদনা ঋণের এমন অপব্যবহার রোধে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘বিশেষ সেল’ গঠনের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ‘যে ঋণ যে উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে বা হবে, সে উদ্দেশ্যেই ঋণের ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রণোদনা ঋণের অর্থ দিয়ে ঋণগ্রহীতাকে তার বিদ্যমান অন্য কোনো ঋণ হিসাব সমন্বয় করতে দেয়া যাবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানা গেছে, কিছু ব্যবসায়ী প্রণোদনা ঋণের টাকা ব্যবসায় না খাটিয়ে অন্য ব্যাংকের ঋণ শোধ করেছেন। আবার কেউ কেউ কম সুদের ঋণের টাকায় বেশি মুনাফা করতে বিনিয়োগ করেছেন লাভজনক অন্য ব্যবসায়। কেউ কিনেছেন জমি–ফ্ল্যাট। অথচ এসব ঋণ দেয়া হয়েছিল চলতি মূলধন হিসেবে, যা দিয়ে প্রতিদিনকার খরচ মেটানোর কথা।
প্রণোদনার ঋণ বিতরণের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকও নির্দেশনা দিয়েছিল, এ ঋণ দিয়ে অন্য ঋণ শোধ করা যাবে না। ঋণের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।
করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার মোট ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এর মধ্যে ১০টি প্যাকেজের আওতায় সিএমএসএমই, বৃহৎ শিল্প ও সেবা, রপ্তানিমুখী শিল্প ও কৃষি খাতে ভর্তুকি সুদে বিতরণের জন্য ৯৩ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
এ ছাড়া, গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসের সার্বিক ব্যাংক ঋণের সুদে ভর্তুকির জন্য ২ হাজার কোটি টাকা দেয় সরকার। আর সিএমএসএমই খাতের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম বাবদ বরাদ্দ দেয়া হয় আরও ২ হাজার কোটি টাকা। এসব প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে সিএমএসএমই ও কৃষি খাতে ঋণ বিতরণে তেমন অগ্রগতি না থাকলেও শিল্প ও সেবা খাতের ঋণ দ্রুত বিতরণ হচ্ছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি ও নির্বাহীদের কাছে পাঠানো চিঠিতে প্রণোদনা ঋণের অর্থ দ্রুত ছাড় করার জন্যও নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, কোভিড-১৯-এর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। পাশাপাশি প্রণোদনা ঋণের অর্থ দ্রুততম সময়ে ছাড় করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে, দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনা ঋণের ৫৩ হাজার কোটি টাকা বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোন ব্যাংক কত টাকা ঋণ দিতে পারবে, তাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।