মহামারিতে বিপর্যস্ত সবকিছু। অর্থনীতির চাকা ধীর হয়ে যাওয়ায় কমছে সাধারণ মানুষের আয়। বেসরকারি হিসাবে করোনার মধ্যে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে আড়াই কোটি। এ সময়ে দ্রুত গতিতে বেড়েছে কোটিপতির সংখ্যাও।
গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে নতুন করে কোটিপতির তালিকায় নাম লিখিয়েছেন ৩৮২ জন। অর্থনৈতিক সংকটের এ সময়ে এমন বৈপরিত্য অবাক করার মতো ঘটনা বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল পাঁচ, যা ১৯৭৫ সালে ৪৭ জনে উন্নীত হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, মহামারিতেও কেন বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সমাজে বৈষম্য থাকায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে, কোটিপতির সবাই অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করেছে, এমন নয়। এসব অর্থের উৎস খুঁজে দেখা প্রয়োজন।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি মানে টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে না, কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। এর ফলে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে দেশে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৮৫ লাখ ৫২ হাজার ৩৩৭টি। এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ ১৩ লাখ ৮৪ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা।
এর মধ্যে ১ কোটি টাকা বা তার বেশি জমা রয়েছে ৯৪ হাজার ২৭২টি ব্যাংক হিসাবে। এই হিসাবগুলোতে জমা আছে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা।
অর্থাৎ মোট আমানতের ৪৩ দশমিক ০৯ শতাংশই তাদের দখলে।
তিন মাস আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কোটি টাকার বেশি হিসাব ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। হিসাবগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
সেই হিসেবে জানুয়ারি থেকে মার্চ এই ৩ মাসে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৩৮২টি। আর এসব হিসাবে আমানত বেড়েছে ১ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা।
এই সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ১ কোটি এক টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা, মার্চ শেষে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ২২৯টি। ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ৭৩ হাজার ৮৭৫টি। তিন মাসে বেড়েছে ৩৫৪টি।
৫ কোটি ১ টাকা থেকে ১০ কোটির টাকার মধ্যে হিসাব রয়েছে ১০ হাজার ৪৯৯টি। তিন মাস আগে যা ছিল ১০ হাজার ৪৭২টি।
১০ কোটি ১ টাকা থেকে ১৫ কোটির মধ্যে আমানতকারী কমেছে। মার্চ শেষে এ ধরনের হিসাব ৩ হাজার ৪৪৬টি। ডিসেম্বরে যা ছিল ৩ হাজার ৫০৭টি।
১৫ কোটি এক টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে হিসাবধারী ১ হাজার ৬৯৩ জন। তিন মাস আগে হিসাবধারী ছিলেন ১ হাজার ৬৩২ জন।
তিন মাসে ২০ কোটি ১ টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে আমানতকারী কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮১টি। ডিসেম্বরে যা ছিল ১ হাজার ১৩৩টি।
২৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে হিসাবধারী ৭৬৬ জন, আগে যা ছিল ৭২৫ জন।
৩০ কোটি ১ টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে আমানতকারী ৩৮৮ জন, ডিসেম্বর এসব অ্যাকাউন্টে হিসাবধারী ছিল ৩৮৪ জন ।
৩৫ কোটি ১ টাকা থেকে ৪০ কোটির মধ্যে হিসাব রয়েছে ২৯৬ জন, আগে যা ছিল ২৯৪ জন।
গত তিন মাসে ৪০ কোটি ১ টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০৪টি। ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ৪৭৮টি।
৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা কমে হয়েছে ১ হাজার ৩৭০ জন। আগে যা ছিল ১ হাজার ৩৯০ জন।
দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা ১৯৮০ সালে ছিল ৯৮ জন, ১৯৯০ সালে ৯৪৩ জন, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২ জন, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭ জন এবং ২০০৮ সালে ১৯ হাজার ১৬৩ জন ছিল।
গত ১২ বছরে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে টাকা খাটাচ্ছে না। এই টাকাগুলোই ব্যাংকে আসছে আমানত হিসেবে।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘করেনার মধ্যেও প্রবাসী আয় আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স পুরোটা খরচ না হয়ে ব্যাংকে জমা থাকছে বা টাকাটা অর্থনীতির মধ্যেই থাকছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে পুঁজিবাজারও বেশ স্থিতিশীল। এ খাতে অনেকের বিনিয়োগ থাকায় সেখান থেকেও আয় হচ্ছে, যা অনেকে ব্যাংকে রাখছেন। আবার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেয়া ঋণের একটা অংশও ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখা হতে পারে।’
কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্য বাড়াটা দীর্ঘমেয়াদের জন্য ভালো নয় বলেও মনে করেন সাবেক এই গভর্নর।