তিন বছর আগে সরকারি চাকরি শেষে অবসরে যান আবু সুফিয়ান। ছেলে-মেয়েসহ চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে। পেনশনের যে টাকা পেয়েছেন, তা থেকে ৪০ লাখ টাকা ১০ শতাংশ সুদে একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখায় ফিক্সড ডিপোজিট বা মেয়াদি আমানত রাখেন।
মাসিক পেনশনের টাকা ও ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের সুদ বাবদ যে আয় আসে, তা দিয়ে মোটামুটি সংসার চলছিল অবসরপ্রাপ্ত এই সরকারি কর্মকর্তার। কিন্তু সংসার চালাতে এখন তার খুব কষ্ট হচ্ছে।
ব্যাংকের সুদহার কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। বর্তমানে মাত্র ৩ শতাংশ সুদ পাচ্ছেন তিনি। ফলে তার আয় কমে যাওয়ায় ধার-দেনা করে কোনো রকমে চলছেন।
মানুষ সঞ্চয় করেন ভবিষ্যতের নিরাপত্তার আশায়। কেউ সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন, কেউ রাখেন সন্তানের বিয়ের খরচের জন্য।
কুমিল্লার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা হাসেম আলী স্বল্পমেয়াদে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) করেছিলেন ব্যাংকে। যখন করেছিলেন, তখন সুদহার ছিল ১০ শতাংশের বেশি। ছেলেকে বিদেশে পাঠাবেন। তাই এফডিআর ভাঙাতে হচ্ছে তাকে।
নতুন করে কিছু টাকা এফডিআর করতে গিয়ে দেখেন, ব্যাংকগুলো ৩ শতাংশের বেশি সুদ দিতে চাইছে না।
ব্যাংকে জমা রাখা টাকার মুনাফা কমে যাওয়ায় এমন লাখ লাখ আমানতকারীর কপালে এখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ। আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় সঞ্চয়ের ওপর নির্ভরশীল অনেকেরই ঠিকমতো সংসার চলছে না। মূল্যস্ফীতি হিসাবে নিলে এখন ব্যাংক আমানতের প্রকৃত হার ঋণাত্মক বা মাইনাস হয়ে গেছে।
ব্যাংকের বিকল্প সঞ্চয়পত্রে সুদহার তুলনামূলক বেশি হলেও সেখানে ক্রয়সীমা বেঁধে দেয়া। আবার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ নিরাপদ মনে করেন না অনেকেই।
এ অবস্থায় আমানতকারীরা যাবেন কোথায়, সে প্রশ্ন উঠেছে।
ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে ঋণের চাহিদা নেই। দীর্ঘ সময় ধরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে খরা যাচ্ছে। কলমানি মার্কেটের অবস্থাও ভালো নয়। ফলে ব্যাংক খাতে তারল্যের পাহাড় জমেছে।
তাদের মতে, বর্তমানে মেয়াদি আমানতের সুদহার তলানিতে, যা আগে কখনোই দেখা যায়নি।
নিরাপদ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের বিকল্প কোনো উৎস না থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যাংকে টাকা রাখছেন বলে জানান তারা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে এ প্রবণতা দীর্ঘ সময় থাকবে না। পরিস্থিতির উন্নতি হলে ঋণের চাহিদা বাড়বে। তখন ব্যাংকগুলোতে অলস তারল্য থাকবে না।
তবে ঋণের সুদহার এবং আমানতের সুদহারের মধ্যে এখন যে পার্থক্য (স্প্রেড), সেটি কোনোভাবে কাম্য নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা।
যোগাযোগ করা হলে সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ও বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিনিয়োগ না হওয়ায় ঋণের চাহিদা কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য জমেছে। ঋণ এবং আমানতের মধ্যে সুদহারের পার্থক্য (স্প্রেড) কমপক্ষে তিন শতাংশ রাখতে হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশিকা রয়েছে।
‘কিন্তু অনেক বেসরকারি ব্যাংকই এ নির্দেশনা মানছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি জোরদার করা উচিত।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা মহামারি শুরুর আগে ব্যাংক খাতে আমানতের সংকট ছিল। বেশি তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলেছিল। তখন ৯ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার দেয়া হতো আমানতকারীদের।
কিন্তু মহামারি-পরবর্তী অর্থনীতিতে বিপর্যয় দেখা দিলে ঋণের চাহিদা কমতে থাকে। এ সুযোগে ব্যাংকগুলো যে যারমতো আমানতের সুদহার কমাতে থাকে।
মহামারির আগে যেসব ব্যাংক গ্রাহকদের মেয়াদি আমানতের জন্য ছয় থেকে নয় শতাংশ সুদ দিত, তারাই এখন সুদহার তিন থেকে চার শতাংশে নামিয়ে এনেছে। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক এটি দেড় শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
২০১৯ সালের জুনে ব্র্যাক ব্যাংক ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের সুদ দিত ছয় থেকে সাড়ে নয় শতাংশ। সেই ব্র্যাক ব্যাংক এখন গ্রাহকদের একই মেয়াদের আমানতের জন্য সুদ দিচ্ছে মাত্র ১ দশমিক ৫০ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
এ মুহূর্তে গ্রাহকদের ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ সুদ দিচ্ছে প্রাইম ব্যাংক। অথচ ২০১৯ সালের জুনেও ব্যাংকটি ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের সাড়ে সাত থেকে সাড়ে আট শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংক বর্তমানে আমানতকারীদের গড়ে সর্বনিম্ন দেড় শতাংশ এবং সর্বোচ্চ সাড়ে চার শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে। অথচ করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় মেয়াদি আমানতের সর্বনিম্ন সুদও ছিল ছয় শতাংশের বেশি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান, বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক প্রধান শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা আনিস এ খান নিউজবাংলাকে বলেন,‘আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে – এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের স্বার্থে আমানতের বর্তমান সুদহার মেনে নিতে হবে।’
তিনি মনে করেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এখন আমনতের সুদহার কম। অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের স্বার্থে আমাদেরকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এখন সময়টা খারাপ হলেও ভবিষ্যতে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হবে বলে আশাবাদী তিনি।
আনিস এ খান আরও বলেন, আমাদেরকে বিনিয়োগের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হবে। বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করে এখানে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে। চাঙা করতে হবে শেয়ারবাজারকে। ন্যাশনাল পেনশন ফান্ড গঠন করে এ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহের পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের প্রায় ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এখন দেশি-বিদেশি মিলিয়ে বেসরকারি খাতে ব্যাংক আছে ৫৬টি।
বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে মোট আমানত আছে প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা। এই আমানতের প্রায় ৫০ শতাংশ মেয়াদি।
আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের লক্ষ্যে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের সুদ হার সর্বোচ্চ ৯ এবং আমানতের জন্য ছয় শতাংশ সুদহার বেঁধে দেয় সরকার। এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমানতের সুদহার কমাতে থাকে ব্যাংকগুলো।
এদিকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার স্বল্প সুদের ঋণ হিসেবে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তার প্রথম দফা ঋণ বিতরণ প্রায় শেষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের মে পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এটি গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
অন্যদিকে ঋণ প্রবৃদ্ধির ভাটার বিপরীতে অলস তারল্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ৯০ হাজার কোটি টাকা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। অবশিষ্ট তারল্য সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুরও মনে করেন, মেয়াদি আমানতের বর্তমান সুদহার মোটেই কাম্য নয়।
তিনি বলেন, ‘দেশে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৬ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর উচিত হবে মেয়াদি আমানতের সুদহার অন্তত মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি দেয়া।’
অতিরিক্ত তারল্যের কারণে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করতে হবে বলে জানান তিনি।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মুদ্রাবাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, বেসরকারি খাতে নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। প্রণোদনার টাকা ছাড়া কোনো ব্যাংকই নতুন কোনো প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে না।
এ পরিস্থিতি ভালো লক্ষণ নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, মুদ্রাবাজারের অতিরিক্ত তারল্য মূল্যস্ফীতিকেও উসকে দিচ্ছে। ঋণের চাহিদা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক হবে না।