বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চামড়ার দাম কমাতে আড়তদাররা ‘একজোট’

  •    
  • ২২ জুলাই, ২০২১ ২২:৪০

আড়তদারদের বিরুদ্ধে এবার সারা দেশেই চামড়ার দাম কৌশলে ফেলে দেয়া এবং আড়তে চামড়া নিয়ে আসা সত্ত্বেও না কেনার মতো অসংখ্য অভিযোগ ওঠেছে। এই নিয়ে সারা দেশেই সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, মসজিদ-মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে চাপা অসন্তোষ।

কোরবানির পশুর চামড়া মানেই যেন সস্তায় কেনা। মাঠ পর্যায়ের সংগ্রহ দাম কম হবে, আড়তে তা কম আরও।

গত কয়েক বছর ধরে দেশে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ ও ক্রয়-বিক্রয়ে এই অনিয়মটাই রীতিমত নিয়মে পরিণত হয়েছে।

এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যদিও মাঠপর্যায় থেকে ওই চামড়ার সংগ্রহ হয়েছে ভালো। কিন্তু আড়তে বিক্রি করতে গিয়ে মেলেনি ন্যায্য দাম।

মৌসুমী ব্যবসায়ী, মসজিদ-মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, দাম ফেলতে পোস্তা, অমিনবাজার, সাভারের হেমায়েতপুর, নাটোর, দিনাজপুর, খুলনা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় চামড়ার আড়তদারদের এক একজোট হওয়া ছিল চোখে পড়ার মতো। কম দামে চামড়া কেনায় তাদের সমানতালে চলেছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

উপায় না দেখে কম দামেই তারা বাধ্য হয়েছে চামড়া ছাড়তে।

আড়তদারদের চামড়া কেনায় অনীহার কারণে সারাদেশে ৫০ শতাংশ খাসির চামড়া নষ্ট হয়েছে। কোথাও কোথাও গরুর চামড়াও বিক্রি করা যায়নি। শেষে ওই চামড়ার ঠিকানা হয়েছে রাস্তায় বা সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনে।

সরকার জাতীয় সম্পদ কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে গত বছরের চেয়ে বর্গফুট প্রতি দাম গরুতে ৫ টাকা ও খাসিতে ২ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করে দেয়।

‘আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা এই দাম বিবেচনায় রেখে কোরবানির পশুর চামড়া ক্রয়-বিক্রয় করবেন’- মূল্য নির্ধারণের ঘোষণা অনুষ্ঠানে চামড়াসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এভাবেই আকুতি জানিয়েছিলেন।

কিন্তু কথা রাখেনি চামড়া ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর অস্থায়ী হাট ছাড়া বাড়তি দাম মেলেনি দেশের বেশিরভাগ জায়গায়।

বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি সরবরাহ মেলে কোরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।

চট্টগ্রামে গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা থেকে ২৩০ টাকার মধ্যে। সিলেটেও একই অবস্থা। কুমিল্লার বেশ কিছু গ্রামের কোরবানিদাতা এক লাখের বেশি দামে কিনেছিলেন কোরবানির পশু। কিন্তু বুধবার ঈদের দিন ওইসব পশুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকায়।

পোস্তার একটি আড়তে চামড়া কিনে সেগুলোতে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে

নাটোর শহরের বড়হরিশপুর বাইপাস এলাকায় আড়তদাররা গরুর চামড়া দাম দিয়েছেন ২০০ টাকা ও খাসির চামড়ায় ১০ টাকা। খুলনায় গরুর চামড়ার মান ও আকারভেদে বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ৫০০ টাকা।

বরিশালে গরুর চামড়ার সর্বোচ্চ দর মিলেছে ৪০০ টাকা। আর ছাগলের চামড়া তো বিনা মূল্যেও কেউ নিচ্ছে না। গাজীপুরে চামড়ার দাম না পেয়ে অনেকে ফেলেছেন রাস্তায়।

বিক্রি করতে না পারায় দিনাজপুরে রামনগর এলাকায় চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের অফিসের সামনে রাস্তায় কয়েক হাজার ছাগলের চামড়া ফেলা হয়েছে রাস্তায়।

বৃহস্পতিবার বগুড়ায়ও পড়েছিল ছাগলের ১০ হাজার চামড়া। বিক্রি করতে না পেরে ওই চামড়াও ফেলে রেখে গেছেন রাস্তায়। পরে ওইসব চামড়া সিটি করপোরেশনের লোকজন তুলে নিয়ে যায়।

আড়তদারদের বিরুদ্ধে এবার সারা দেশেই চামড়ার দাম কৌশলে ফেলে দেয়া এবং আড়তে চামড়া নিয়ে আসা সত্ত্বেও না কেনার মতো অসংখ্য অভিযোগ ওঠেছে। এই নিয়ে সারা দেশেই সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, মসজিদ-মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে চাপা অসন্তোষ।

নাটোরের বড় হরিশপুর এলাকার মৌসুমী ব্যবসায়ী ওহায়েদ মোল্লা জানান, সিন্ডিকেটের কারণে চামড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তার মতো অনেকেই।

রাজধানীর শান্তিনগর উম্মে হাবীবা হাফেজিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ১২০ পিস চামড়া নিয়ে আসে পোস্তা এলাকায়। মাদ্রাসার মুহতামিম আব্দুল আজিজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৭৪টিই ছিল বড় গরুর চামড়া। শুনেছি বড় গরুর চামড়া কোথাও কোথাও ৭০০-৮০০ টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু পোস্তায় চামড়া এনে আমাদের বিক্রি করতে হয়েছে গড়ে ৬০০ টাকায়। মাঝারি আকৃতির বাকি ৪৬ পিস চামড়া গড়ে বিক্রি করতে ৪০০ টাকা হারে।‘

চামড়া পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ফতেপুর মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা মাহমুদুল হাসান ফতেপুরী নিউজবাংলাকে জানান, ‘দেশে তো চামড়ার দাম নাই। গত বছরও পাই নাই। এ বছরও না। আমরা মোট ১৩শ’ চামড়া সংগ্রহ করেছি। ওই চামড়াগুলো ঈদের দিন তিন দফায় বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতি পিস ২৩০, ২০০ ও ১৭০ টাকা হারে পেয়েছি।

‘বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনে আরও নতুন সংগ্রহ করা চামড়া বিক্রি করেছি, যেগুলোর দাম দেয়া হয়েছে মাত্র ১০০ টাকা করে।’

চামড়ার দাম নিয়ে তাদের এতটাই বেদনা যে এই নিয়ে তিনি কাউকে বলতেও চান না, দোষারোপও করতে চান না। শুধু বলেন, ‘এতে গরিবের হকই নষ্ট করা হচ্ছে।’

এই চামড়াগুলোর একটি অংশ বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দেয়া হয়েছে, একটি অংশ কেনার পর রাস্তায় রেখেছে আড়তদাররা

যশোর মনিরামপুর উপজেলার জামিয়ো ইমদাদিয়া বালক-বালিকা মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা রশিদ আহমেদ বলেন, ‘মাঠ পর্যায় থেকে চামড়া সংগ্রহের বিষয়টি এখন মূল্য বিবেচনায় নিয়ম রক্ষার দায়ে পরিণত হয়েছে। না গেলে বলবে মাদ্রাসার কি টাকার দরকার নেই? শিক্ষার্থীদের জীবন-জীবিকা নির্বাহে চামড়া ও এর থেকে পাওয়া টাকা তো দরকারই। না হলে চলবে কী করে?

‘কিন্তু এর থেকে যে দাম পাওয়া যায়, যে পরিবহন খরচ আছে এবং এর সঙ্গে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের পরিশ্রমের মূল্য ধরলে বিনা পয়সার চামড়াতেও লাভ-লোকসানের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। এটা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে মাদ্রাসাগুলো একটা সময় বিনা পয়সার চামড়া নিতেও আর মাঠে নামবে না।’

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রবিউল আলম বলেন, ‘সারা দেশে অন্তত ৫০ শতাংশ ছাগলের চামড়া বিক্রি করা যায়নি। ওই চামড়া নষ্ট হয়েছে। একইভাবে গরুর চামড়ার দামও শোচনীয়। এর জন্য আড়তদার, ট্যানারি মালিক ও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারকদের যৌথ শক্তিশালী সিন্ডিকেটই দায়ী। এদের অপতৎপরতার কারণেই প্রতিবছর কোরবানি এলে চামড়ার দাম নিয়ে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়।’

তবে বলতেই হবে সরকার এবার চামড়ার বর্গফুট প্রতি দাম ৫ টাকা বাড়ানোয় কোথাও কোথাও কিছু চামড়া গতবারের তুলনায় বেশি দাম পেয়েছে। কিন্তু মূল্য নির্ধারণেও শুভঙ্করের ফাঁকি থাকায় বেশিরভাগ জায়গাতেই মিলেনি ন্যায্যদাম।

এর ব্যাখা দিয়ে রবিউল বলেন, ‘লবণজাত চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ বা দায়িত্ব নেয়া হয়নি। উচিত ছিল সঙ্গে কাঁচা চামড়ার দরও ঠিক করে দেয়ার। সেটি না হয়নি বলেই এবার দাম বাড়িয়েও কোনো সুফল আসেনি।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আড়তদারদের বৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান নিউজবাংলাকে জানান, ‘সিলেট ও চট্টগ্রামসহ কিছু জায়গায় চামড়ার দরটা কম ছিল। ওইসব জায়গায় দর পরিস্থিতি নিয়ে আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি। বাকি জায়গায় চামড়ার দাম খারাপ হয়নি। বরং গতবারের তুলনায় ১০০-২০০ টাকা বেশি পেয়েছে।’

তবে সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দেয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করতে রাজি হননি।

চামড়া কেনার পর শ্রমিক দিয়ে সেগুলোতে গুদামে পাঠাচ্ছেন আড়তদাররা

দর পেলে চামড়া কেন বিক্রি হবে না বা আড়তদারদের চামড়া না কেনার কারণ কি এমন প্রশ্নের জবাবে আফতাব খান বলেন, ‘ছাগলের চামড়ার দাম বৈশ্বিকভাবেই কম। দেশেও কম হওয়ায় এর সংগ্রহ, ক্রয় এবং সংরক্ষণ খুবই ব্যয়বহুল। এসব কারণে ছাগলের চামড়ায় কিছু নষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক।

‘আর গরুর চামড়া যেগুলো নষ্ট হয়েছে সেগুলো আনতে আনতেই লাইফটাইম ফুরিয়ে গেছে। এতে ওইসব চামড়া গুণগতমান হারিয়ে যায়। ওই চামড়া কিনে কোনো লাভ হবে না। বরং প্রক্রিয়াজাতে বাড়তি ব্যয় হবে। এর ফলে কিছু গরুর চামড়াও নষ্ট হতে পারে। কিন্তু এর পরিমাণ খুবই সামান্য এবং তা শতাংশে উল্লেখ করার মতো নয়।’

আফতাব খানের সমিতির তথ্যমতে, এবার কোরবানিতে সব মিলিয়ে ৭০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ সম্ভব হবে। এর মধ্যে ৪৪ লাখ পিস গরুর চামড়া। বাকি ২৬ লাখ চামড়ার যোগান মিলবে ছাগল-ভেড়া, খাসি থেকে।

এ বিভাগের আরো খবর