বেতন কমানো নিয়ে পাইলট অসন্তোষের খবরে গত কয়েক দিনে ৭ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আয় বঞ্চিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পাইলট অসন্তোষের খবরে শঙ্কিত অনেক যাত্রী ভ্রমণ বাতিল করা বা ফিরিয়ে দেয়ায় এ ক্ষতি হয়েছে বিমানের।
গত বছর দেশে করোনা মহামারি শুরু হলে ব্যয় সংকোচন করতে অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্দিষ্ট হারে পাইলটদেরও বেতন কাটছিল বিমান কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি বিমান সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগস্ট থেকে কর্মকর্তাদের বেতন আর কাটা হবে না। কিন্তু পাইলটদের ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি।
অবশ্য বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, বিমানের আয় স্বাভাবিক হলে পাইলটদের বেতন থেকে কর্তিত টাকা ফেরত দেয়া হবে।
পাইলটরা বলছেন, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে আগস্ট থেকে চুক্তির অতিরিক্ত কোনো দায়িত্ব তারা আর পালন করবেন না। সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বিমান কর্তৃপক্ষকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)।
বেতন কাটা নিয়ে বিমান নতুন যে আদেশ জারি করেছে, তাতে বলা হয়েছে, বিমানে কর্মরত ‘কর্মকর্তা’ এবং যেসব ককপিট ক্রুর চাকরির বয়স শূন্য থেকে পাঁচ বছর, জুলাই মাসে তাদের কোনো বেতন কাটা হবে না। তবে যেসব ককপিট ক্রুর চাকরির বয়স ৫ থেকে ১০ বছর, জুলাই মাসে তাদের বেতন থেকে ৫ শতাংশ এবং যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন, তাদের বেতন ২৫ শতাংশ কাটা হবে। এ সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন পাইলটরা।
বিমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পাইলটদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স পাঁচ বছরের মধ্যে, স্বাভাবিক সময়ে তাদের বেতন ২ লাখ ৬ হাজার ৮৪ টাকা। যাদের চাকরির বয়স ৫ থেকে ১০ বছর, তারা ওভারসিজ ভাতা হিসেবে অতিরিক্ত পান ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এতে তাদের বেতন হয় ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।
যাদের চাকরির বয়স ১০ থেকে ২০ বছর, তাদের বেতন ওভারসিজ ভাতা সহ ১০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। আর যাদের চাকরির বয়স এর চেয়ে বেশি, তারা পান ১২ লাখ ১ হাজার টাকা। এছাড়া চুক্তির অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালন করলে তাদের আলাদা করে দেয়া হয় প্রোডাক্টিভিটি অ্যালাওয়েন্স পান।
আগে পাইলটদের নির্দিষ্ট হারে যে ওভারসিজ ভাতা দেয়া হতো, তা করোনায় আয় কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন করে বর্তমানে ফ্লাইং ঘণ্টা হিসেবে সেটি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান বোর্ড।
বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে লন্ডন রুটে একটি, দোহা রুটে তিনটি, জেদ্দা রুটে তিনটি, রিয়াদ রুটে ছয়টি এবং দাম্মাম রুটে তিনটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান। এছাড়াও বিভিন্ন গন্তব্যে প্রয়োজন অনুসারে চার্টার্ড ফ্লাইটও চালু রয়েছে।
বর্তমানে বিমানে সব মিলিয়ে ১৫৭ জন পাইলট কর্মরত রয়েছেন। বাপার সঙ্গে বিমানের যে চুক্তি, তা অনুযায়ী একজন পাইলটের দৈনিক সর্বোচ্চ ১৩ ঘণ্টা কাজ করার কথা। সপ্তাহে একজন পাইলট কাজ করবেন সর্বোচ্চ ৭৫ ঘণ্টা। এর বাইরেও তিনি সপ্তাহে দুদিন ছুটি পাবেন।
বাংলাদেশ পাইলট এসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিমানের বেতন কাটার প্রক্রিয়াটা শুরু থেকেই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। আমাদের বেতনের অন্তর্ভুক্ত ওভারসিজ ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। এই ভাতাটি ২০১০ সাল থেকে বিমানের পাইলটদের বেতনের অংশ হিসেবে দেয়া হচ্ছিল। বেতন থেকে ওভারসিজ ভাতা বাদ দিয়ে যে টাকা হচ্ছে, সেটার ওপর আবারও কর্তন করা হচ্ছে।
‘যাদের ২৫ শতাংশ বেতন কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিমান, হিসাবের ত্রুটির কারণে তাদের বেতন কাটা হয়েছে ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত। যাদের ৫০ ভাগ বেতন কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের বেতন কেটেছে ৭২ শতাংশ। বিমান আইন লঙ্ঘন করে এককভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিমানের সঙ্গে পাইলটদের একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে। তারা এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।’
তিনি বলেন, ‘৩০ জুলাইয়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে আমরা চুক্তির বাইরে কোনো ডিউটিই করব না। নিয়ম অনুযায়ী, আমার দৈনিক ১৩ ঘণ্টা ফ্লাইট করার কথা, এটি ১৪ ঘণ্টা হলে আমি যাব না। জোর করে তো কাউকে দিয়ে ওভারটাইম করানো যাবে না।’
অবশ্য পাইলটদের সাথে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই বলে দাবি করেছেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সহাবস্থানেই আছি। কেউ কোনো বিরুদ্ধ অবস্থানে নেই। বিমান গন্তব্যে ঠিক ঠাক মতোই যাবে।
‘তারা আমাদের যে চিঠিটা দিয়েছে, তাদের কয়েকজন বেতন পাচ্ছেন না, এটাই তারা জানিয়েছেন। সবারটা ঠিক হয়ে গেলো, আমাদের কয়েকজনেরটা বাকি, এটাই তারা বলেছেন। এটা ছাড়া আর কিছু না। এটা বলবেনই, আমি-আপনিও বলব। এখন আমাদের কাছে ফান্ড চলে আসলে আমরা তাদেরটা দিয়ে দেব। কোনো অসুবিধা নেই।
তিনি জানান, পাইলটদের অসন্তোষের খবর প্রচারিত হওয়ায় অনেক যাত্রী শঙ্কিত হয়ে গত দু-তিন দিনে বিমানের টিকেট ফিরিয়ে দিয়েছেন। এতে তাদের ৭ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।