মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ার ছয়টি কারণ খুঁজে পেয়েছে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক।
সংস্থাটি বলেছে, ২০২০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি কমলেও দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে।
মহামারিকালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।
টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার মতো, যা নতুন অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের এক-তৃতীয়াংশের বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বছর বা অর্থবছরে এত বেশি রেমিট্যান্স কখনই আসেনি।
গত বছরের মার্চে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর সবাই আশঙ্কা করেছিল যে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যাবে। তার লক্ষণও দেখা দিয়েছিল। এপ্রিল-মে মাসে সব দেশেই রেমিট্যান্সের গতি নিম্মমুখি ছিল। এখনও অনেক দেশের এই প্রবাহে নিম্মগতি অব্যাহত আছে।
কিন্তু বাংলাদেশে ঘটেছে তার ঠিক উল্টো। মহামারির এই সংকটকালে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বেড়েই চলেছে। সরকারের নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ, দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থা, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রতিমাসেই রেকর্ড হয়েছে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচকে। কিন্তু কেউ সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বের করতে পারছিলেন না।
মহামারি শুরুর পরপর গত বছরের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়ে বলেছিল, কোভিড-১৯ এর কারণে ২০২০ সালে বিশ্বে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমবে ২০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে ২২ শতাংশ কমে ১৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল করোনায় রেমিট্যান্স কমবে ২০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথম বছর বাড়ে ১৮.৪ শতাংশ
কিন্তু ২০২০ সাল শেষে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ২২ বিলিয়ন রেমিট্যান্স আসে। প্রবৃদ্ধি হয় ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও এই মহামারিকালে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে। তবে, বাংলাদেশের মতো অতটা উল্লম্ফন হয়নি কোথাও। বিশ্বব্যাংক এখন তথ্য দিচ্ছে, করোনার মধ্যে ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্স বেড়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশে এটি আরও বেশি।
এই তথ্যে বিস্মিত হয়ে বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্স বাড়ার কারণ খুঁজতে শুরু করে। শেষ অবধি ৬টি কারণ বের করেছে তারা। আর তা নিয়েই ১৩ জুলাই একটি মতামত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিবেদনটি লিখেছেন বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ভালেরি মার্সার-ব্ল্যাকম্যান এবং বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক ই ক্লেয়ার লি।
সঞ্চয় দেশে পাঠানো
করোনার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসী শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমেছে। ফলে প্রবাসে বহু শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। তারা নিজেদের সঞ্চয় দেশে নিয়ে এসেছেন।
বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন হচ্ছে, সহানুভূতি বা অন্য কোনো কারণে স্বজনদের আগের চেয়ে বেশি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা
প্রতিবেদনে একটি উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, সৌদি আরব আগে যেখানে প্রতি প্রান্তিকে ৪০ হাজার লোককে কাজের সুযোগ দিত; ২০২০ সালের প্রথম ও তৃতীয় প্রান্তিকে দিয়েছে ১০ হাজার।
বৈধ উপায়ে অর্থ প্রেরণ
মহামারিকালে অবৈধ পথ বন্ধ থাকায় বৈধ উপায়ে প্রবাসীরা বেশি অর্থ নিজ নিজ দেশে পাঠিয়েছেন। ভ্রমণনিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে অনেক প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরতে পারেননি। এতে বন্ধু বা স্বজনদের মাধ্যমে দেশে অর্থ প্রেরণের সুযোগও কমে যায়। তাই বৈধ উপায়ে দেশে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে।
পরিবারের প্রতি সহানুভূতি
করোনার কঠিন সময়ে এই দেশগুলোর প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে থাকা পরিবারগুলো নানা সমস্যায় পড়েছে। তাই পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তারা নিজেরা কষ্ট করে হলেও দেশে আগের চেয়ে বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন।
নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন
প্রবাসী আয় দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হচ্ছে। নানা ধরনের আর্থিক চ্যানেল তৈরি হয়েছে। জিপে ও আলিপের মতো অর্থ প্রেরণের অ্যাপস এসেছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রবাসী আয় পাঠানো সহজ হয়েছে।
কর ছাড় বা আর্থিক প্রণোদনা
কর ছাড় বা আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় পাঠানোকে উৎসাহিত করেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালে ১ জুলাই থেকে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার স্বজন ১০২ টাকা তুলতে পারেন।
করোনাকালে অনেক বাংলাদেশি তাদের সঞ্চয়সহ দেশে চলে এসেছেন
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক দুই ঈদ উৎসবে এই ২ শতাংশের সঙ্গে বাড়তি আরও ১ শতাংশ যোগ করে ৩ শতাংশ প্রণোদনা দেয়।
বড় দেশের প্রণোদনা অর্থ
করোনাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো নানা ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে। সেই প্রণোদনার অর্থের কিছুটা অংশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসী শ্রমিকেরাও পেয়েছেন। সেটা অনেকেই দেশে নিজেদের পরিবারের কাছে পাঠিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারির এই সংকটকালে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক নিম্ন-আয়ের পরিবারের জন্য রেমিট্যান্স দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান স্থিতিশীল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।
‘তবে, একটি বিষয় বিবেচনায় রাখাতে হবে, রেমিট্যান্সপ্রবাহের এই ইতিবাচক ধারা কিন্তু সাময়িক; স্থায়ী নয়। যে সব দেশে শ্রমিকরা কাজ করে সেই দেশগুলো কোভিডের পরে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, তার ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনগুলোর রেমিট্যোন্সপ্রবাহ।’
গত মে মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সপ্রবাহের উল্লম্ফন নিয়ে বলা হয়, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর মধ্যে ২০২০ সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম স্থানে রয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে ভারতে ৮৩ বিলিয়ন ডলার, চীন ৬০ বিলিয়ন ডলার, মেক্সিকো ৪৩ বিলিয়ন ডলার, ফিলিপাইন ৩৫ বিলিয়ন ডলার, মিশর ৩০ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তান ২৬ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশ ২২ বিলিয়ন ডলার, নাইজেরিয়া ও ভিয়েতনামে ১৭ বিলিয়ন ডলার এবং ইউক্রেনে এসেছে ১৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স।