দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য চাল আমদানিতে হঠাৎ করেই হিড়িক পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে দেদার চাল আমদানি হচ্ছে। আর এর ফলে সরকারি গুদামগুলোতে চালের মজুত বেড়ে প্রায় ১৩ লাখ টনে ঠেকেছে।
কিন্তু এরপরও চালের দাম কমছে না, উল্টো বেড়েই চলেছে। সরকারি তথ্যই বলছে, দেশে মোটা চালের কেজিই এখন ৫০ টাকার ওপরে। সরু চাল কিনতে গুনতে হচ্ছে ৭০ টাকার মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) চাল আমদানির জন্য ৮৫ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। আগের ১১ মাসের চেয়ে এই ১১ মাসে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ২১০ গুণ।
২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে মাত্র ৪০ লাখ ৭০ হাজার ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।
এই ১১ মাসে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ২৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের; বেড়েছে ৫ হাজার ৬৯১ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ডলারের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই ১১ মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য সবমিলিয়ে ৫ হাজার ৯৩৪ কোটি ৫৫ লাখ (৫৯.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি।
তথ্যে দেখা যায়, অর্থবছরের শেষ দিকে এসে প্রায় সব ধরনের পণ্য আমদানি বাড়লেও চাল আমদানিতে উল্লম্ফন হয়েছে।
চালের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে গত বছরের শেষের দিকে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। একইসঙ্গে সরকারি উদ্যোগেও চাল আমদানি অব্যাহত রাখা হয়। কিন্তু প্রথম দিকে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি।
সরকারের পক্ষ থেকে বার বার তাগাদা দেয়ার পর মার্চ থেকে তারা চাল আমদানির গতি বাড়িয়ে দেয়। এখনও সেটা অব্যাহত আছে।
২০২১ সালের শুরু থেকেই চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি গুদামে মজুত এবং বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারি গুদামে চালের মজুত ছিল মাত্র ৫ লাখ ২৫ হাজার টন।
দেশের সরকারি চালের গুদামের মজুতক্ষমতা প্রায় ২৫ লাখ টন। সরকারি গুদামে ন্যূনতম ১২ থেকে ১৫ লাখ টনের মজুত থাকার নিয়ম রয়েছে। গত বছরও একই সময়ে ১৩ লাখ টনের বেশি চাল মজুত ছিল।
সরকারি গুদামে চালের মজুত বাড়াতেই বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। একইসঙ্গে সরকার নিজেও সরাসরি আমদানি করতে থাকে।
চাল আমদানি শুরু হলেও বাজারে দামের কোনো প্রভাব পড়েনি। সরকারি হিসাবেই বাজারে মোটা চালের কেজি এখন ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। অথচ গত বছরের এই সময়ে মোটা চাল প্রতি কেজি ৩২ থেকে ৩৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির জন্য ৩০০ জন ব্যবসায়ীকে অনুমতি দিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৬৪ হাজার টন চাল দেশে এসে পৌঁছে। আর সরকারিভাবে ৬ লাখ টন আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও এসেছিল ৪৬ হাজার টন চাল।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ১১ জুলাই সরকারি গুদামগুলোতে মোট ১৫ লাখ ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ১২ লাখ ৬৬ হাজার টন; আর গম হচ্ছে ১ লাখ ৮৪ হাজার টন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, চালের দাম না কমায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন চাল ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকেরা। আবার তাদেরই চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তারা দ্রুত চাল আমদানি করলে দাম কমে যেতে পারে, সে কারণেই তারা আমদানিতে গড়িমসি করছিলেন। এখন আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছে; তাই বাড়ছে।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারপরও কি দাম কমবে? এই যে গড়িমসি করে কৌশলে বেশি দামে বিক্রি করল, তারই বা কী হবে? মহামারির এই সংকটকালে মানুষকে আর কতো দুর্ভোগ পোহাতে হবে?’
চাল আমদানি নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের মতামত জানতে তার মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস করা হলেও কোনো জবাব দেননি।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ মুজিবর রহমানকে ফোন দেয়া হলে হলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি এবং মুসা করিম অ্যান্ড সন্সের কর্ণধার মহসিন মিলন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার আমাদের চাল আমদানির যে কোটা দিয়েছিল, সে কোটা পূরণ করতেই ব্যবসায়ীরা প্রচুর এলসি খুলেছিলেন।’
এরপরও দাম কমছে না কেন, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সরকারের মজুত কমে যাওয়ার তথ্য ব্যবসায়ীরা জানতে পেরে তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। এখনও সে প্রবণতা অব্যাহত আছে।