বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শ্রমিকের বিমায় আইন আছে, প্রয়োগ নেই

  •    
  • ১৩ জুলাই, ২০২১ ১৪:১৫

শ্রম আইন বলছে, কর্মস্থলে কোনো শ্রমিক মারা গেলে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই ৫ লাখের মধ্যে ২ লাখ টাকা সরকার, ২ লাখ বিমা কোম্পানি এবং ১ লাখ টাকা কারখানা মালিকের দেয়ার কথা। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বিমা করে না। মালিকও অনেক সময় পিছুটান দেয়। তাই শ্রমিকের পরিবারের শেষ পর্যন্ত ভরসা সরকারের দেয়া ২ লাখ টাকাই।  

কারখানায় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার পর নিহতের স্বজন আর আহত শ্রমিকদের আর্থিক দুর্দশার যে খবর প্রতিবার গণমাধ্যমে আসে, তার একটি সমাধান আছে আইনেই। কিন্তু মালিকপক্ষ তা উপেক্ষা করায় দুর্ঘটনার পর তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

অথচ আইনে শ্রমিকের পরিবারকে আর্থিক দিক থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনবিমা করার কথা বলা আছে। দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হলে তার পরিবার একটি ভালো অঙ্কের ক্ষতিপূরণ পেতে পারত। কিন্তু বিমা করার হার খুবই কম।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের কারখানায় আগুনে যে ৫২ জনের মৃত্য হয়েছে, তাদের কারও জীবন বিমা করা ছিল, এমন তথ্য দিতে পারছে না কারখানা কর্তৃপক্ষ।

শ্রম আইন বলছে, কর্মস্থলে কোনো শ্রমিক মারা গেলে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই ৫ লাখের মধ্যে ২ লাখ টাকা সরকার, ২ লাখ বিমা কোম্পানি এবং ১ লাখ টাকা কারখানা মালিকের দেয়ার কথা।

কিন্তু দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বিমা করে না। মালিকও অনেক সময় পিছুটান দেয়। তাই শ্রমিকের পরিবারের শেষ পর্যন্ত ভরসা সরকারের দেয়া ২ লাখ টাকাই।

শ্রম আইনে যেসব কারখানায় কমপক্ষে ১০০ শ্রমিক আছে, সেখানে গ্রুপ বিমা থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন জানান, এই বিধান মানা হয় না সেভাবে।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি কল-কারখানার বিমা করার আইন আছে। যে ভবনে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, সেটা ভাড়া বা নিজস্ব যেটা হোক না কেন বিমা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেকেই ভবনের বিমাও করে না, শ্রমিক তো দূরের কথা। আবার কেউ কেউ করলেও সেখানে কতজন কাজ করে সেটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে না।’

বিমা করলে কারখানা ভবন নিরাপদ হতে পারত বলেও মনে করেন কবির হোসেন।

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দুর্ঘটনার পর দেখা যায় ভবনে অনেক ত্রুটি আছে। কিন্তু বিমা করার আগে কোম্পানিগুলো সমীক্ষা করে দেখে বিল্ডিংটা যথাযথভাবে আছে কি না। রাজউকের অনুমোদন, কত বছরের পুরাতন, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন করা হয়েছে কি না, সমীক্ষায় এসব বিষয় দেখা হয়।

‘তখন কোনো সমস্যা থাকলে সেটা বেরিয়ে আসে। এ জন্য ভবনের বিমা করা যেন বাধ্যতামূলক করা হয়, সে বিষয়ে মেয়রদেরও চিঠি দেয়া হয়েছে।’

যখন কেউ কথা শুনতে চায় না কখন আইন করে সেটা বাধ্যতামূলক করা উচিত বলে মত দেন কবির।

তিনি বলেন, ‘গ্রুপ বিমায় সরকারকে আরও নজর দিতে হবে। শিল্প কারখানার লাইসেন্স দেয়ার আগে গ্রুপ বিমা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিমা না থাকলে সেসব কারখানার লাইসেন্স বাতিল করা উচিত।’

ঝুলে আছে শিল্প খাতে বিমা সুরক্ষা

দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা আছে, কিন্তু নেই বাস্তবায়ন। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই সবাই নড়েচড়ে বসে, কিন্তু তার কিছুদিন পরই সবাই চুপ।

মালিক পক্ষ নানা অজুহাত তুলে বাস্তবায়ন করছে না। অপ্রতিষ্ঠানিক খাতে তো প্রশ্নই ওঠে না, প্রতিষ্ঠানিক খাতেও বিমার আলোচনা নেই।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ জরিপ অনুসারে, দেশে বড়, মাঝারি, ছোট, অতি ক্ষুদ্র সব মিলিয়ে কারখানা আছে ৪৬ হাজার ২৯১টি। আর বিভিন্ন খাতে শ্রমিক ৯ কোটি ৬২ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৭ কোটি ১২ লাখ ও নারী ২ কোটি ৫০ লাখ।

জরিপ অনুযায়ী, এসব কারখানায় বছরে গড়ে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮০ হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে শিল্প উৎপাদন খাতে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ২৯ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে।

গবেষণা বলছে, ৮০ ভাগ কারখানাতেই শ্রমিকদের বিমা নিশ্চিত করা হয় না।

পোশাক খাতেও বিমা কম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় এসেছে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের শীর্ষ খাত পোশাক রপ্তানি। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগের বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। আর এ রপ্তানি আয়ের অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক।

কিন্তু মোট শ্রমিকদের মাত্র এক শতাংশ আছে স্বাস্থ্য বিমার আওতায়। বাকি ৯৯ ভাগই বিমার সুযোগ পাচ্ছেন না।

শতকরা ৪০ জন শ্রমিক স্বাস্থ্যসেবার উচ্চমূল্যের জন্য যথাযথ সময়ে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারেন না।

স্বাস্থ্য বিমার সুবিধায় আছে মাত্র ৩৫টি কারখানার ৫৮ হাজার ২৬১ জন শ্রমিক।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানান, শ্রমিকপ্রতি বিমার দুই লাখ টাকা সরকারের কল্যাণ তহবিলে জমা দিতে হয়। সেখান থেকে যেকোনো ধরনের সংকটে অর্থে সংস্থান করে সরকার।

পোশাক শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার জন্য আইএলও উদ্যোগ নিলে এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে সরকার। এ লক্ষ্যে শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে এক লাখ ৫০ হাজার শ্রমিককে বিমা সুবিধার আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি এ কার্যক্রম সফলভাবে শেষ হলে সব পোশাক কারখানায় এটি চালু হওয়ার কথা।

বড় বড় কয়েকটি দুর্ঘটনা

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে মারা যায় ১১২ জন শ্রমিক।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে মারা যায় ১ হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭২৯ জন শ্রমিক। ২০১৯ সালে মারা যান ১ হাজার ২০০ জন।

আর ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় ২ হাজার শ্রমিক।

কী বলছেন উদ্যোক্তা ও শ্রমিক নেতা

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এবং শিল্প উদ্যোক্তা শামস মাহমুদ বিমা না করার যুক্তি হিসেবে নিউজবাংলাকে বলেন, “বাংলাদেশে ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ অনেক বেশি। এ জন্য ব্যবসা শুরুর দিকে কোন দিকে খরচ বাঁচানো যায়, সেদিকে মনোযোগ থাকে বেশি।”

তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টস খাতে বিজিএমইএর তদারকি খুব বেশি। বিদেশি ক্রেতা ধরার ক্ষেত্রে গার্মেন্টসগুলোর পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। এ জন্য সেখানে আগের থেকে পরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে। তাই সেখানে বিমা করার উদ্যোগ কার্যকর হচ্ছে।’

স্থানীয় বাজারে তদারকির দুর্বলতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকারি এজেন্সিগুলোর তদারকির ক্ষেত্রে গ্যাপ রয়েছে। এ জন্য সরকার ইকোনমিক জোন করার পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে সরকার এখানে নজরদারি বাড়াতে পারে।’

ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ভূমিকা আরও বাড়াতে হবে বলে মত দেন শীর্ষ এ ব্যবসায়ী।

তিনি বলেন, ‘লোকাল মার্কেটে ছোট ছোট যে ব্যবসাগুলো আছে, যাদের বিমা নেই সেখানে শ্রমিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম আরও বাড়ানো উচিত।’

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিনুল হক আমিন এই ঘটনার জন্য শ্রমিকদের জন্য মালিকদের দায়বদ্ধতার অভাবকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, ‘দেশে যারা শিল্পপতি, পুঁজির মালিক, তারা শ্রমিকদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা উচিত তার ধারেকাছেও যায় না। তারা শুধু মুনাফা চায়। সরকারেরও উৎপাদনমুখী শ্রমিক শ্রেণির প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই।

‘গার্মেন্টস খাত সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। সে জন্য ক্রেতাদের চাপে পড়ে। মালিক এবং সরকার সেদিকে বেশি নজর দিয়েছে। অন্য খাতগুলো যেহেতু গার্মেন্টেসের মতো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে না, সে জন্য সেসব খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিকে নজর কম।’

এ বিভাগের আরো খবর