বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোট যত কালোটাকা সাদা হয়েছে তার ৬০ শতাংশই হয়েছে সদ্য বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে। ২০০৭-০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মানুষ ভয়ে যত কালোটাকা সাদা করেছিলেন, তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সাদা হয়েছে এই এক বছরে।
হঠাৎ করে কালোটাকা সাদার এই জোয়ারের তথ্য সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেনো এই উল্লম্ফন? কয়েকজন অর্থনীতির গবেষকের সঙ্গে আলাপ করে মিলেছে তার উত্তর।
তারা দিয়েছেন চমকপদ তথ্য; বলেছেন, মহামারি করোনাভাইরাসে কড়াকড়ির কারণে বিদেশে টাকা পাচার করতে না পেরে সেই টাকা সাদা করেছেন অনেকে। আর সে কারণেই আকস্মিক বেড়ে গেছে কালোটাকা সাদা করার অঙ্ক।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় সব সরকারই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। এ পর্যন্ত দেশে ১৫ অর্থবছরে এ সুযোগ দিয়ে সব মিলিয়ে ৩৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা হয়েছে। আর তা থেকে সরকার কর পেয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা মত।
এরমধ্যে গত ২০২০-২১ অর্থবছরেই সাদা হয়েছে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। প্রায় ১২ হাজার করদাতা এই টাকা সাদা করেছেন। অর্থবছরের শেষ মাস জুনেই ১ হাজার ৪৫৫ জন ৬১৯ কোটি টাকা সাদা করেছেন। কর হিসাবে সরকারের কোষাগারে এসেছে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা।
এর আগে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা সাদা হয়েছিল ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, যখন দেশের পরিস্থিতি ছিল একেবারেই ভিন্ন।
ওই দুই বছরে ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগ নিয়েছিল; বৈধ হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। তা থেকে সরকার কর পেয়েছিল এক হাজার ২০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে ২০০৭ সালে ৮০৩ কোটি টাকা এবং পরের বছর ৪০০ কোটি টাকা কর পেয়েছিল এনবিআর।
এ হিসাবেই বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোট যতো কালোটাকা সাদা হয়েছে তার ৬০ শতাংশই হয়েছে সদ্য বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে। আর ২৬ শতাংশ হয়েছে ২০০৭-০৮ সালে।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালোটাকা সাদা করার জোয়ারের দুটি কারণ খুঁজে বের করেছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রথম কারণে হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী এখন কোভিড-১৯ মহামারির ছোবল। এ ছোবলে সবকিছুই ওলোটপালট হয়ে গেছে; পাল্টে গেছে হিসাবনিকাশ। যে সব চ্যানেলে বা পথে টাকা পাচার হতো, সেগুলোও ঠিকমতো চলছে না। ঝুঁকিও আছে; টাকা মার যেতে পারে। সে সব চিন্তা করেই এখন অনেকে টাকা পাচার না করে সেই টাকা সাদা করে বৈধ করছে।’
‘মোদ্দা কথা, করোনার কারণে দেশ থেকে টাকা বিদেশে নেওয়ার সুযোগ কমে গেছে; তাই এবার বাধ্য হয়ে সুযোগ নিয়েছেন।
‘আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, এখন পর্যন্ত যতবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে, তারমধ্যে গত অর্থবছরের সুযোগটি ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কোনো প্রশ্ন ছাড়া টাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। সে সুযোগও অনেকে কাজে লাগিয়েছেন।’
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে বহু জন সরকারের সমালোচনা করেন। তবে সরকার বরাবর বলে আসছে, যে টাকার কোনো হিসাব থাকে না, সেটি অর্থনীতির মূলধারায় তারা নিয়ে আসতে চান। এতে বিনিয়োগ বাড়ে। নইলে সেটি আবার পাচার হয়ে যায়।
আহসান এইচ মনসুরও এই মতের পক্ষেই বলেছেন। আবার সরকার অন্য বছরের তুলনায় এবার যে কর বাড়িয়েছে, সেটিও সমর্থন করছেন।
আগের বছর কিছু খাতে বিনিয়োগ করলে কেবল ১০ শতাংশ কর দিয়েই কালোটাকা সাদা করা যেত। তবে চলতি অর্থবছর থেকে কর আড়াই গুণ করার পাশাপাশি আরোপ করা হয়েছে জরিমানা।
আহসান মনসুর বলেন, ‘এই ডামাডোলের মধ্যেও কিন্তু সরকার ২ হাজার কোটি টাকার কম পেয়েছে। তবে, নতুন বাজেটে ২৫ শতাংশ কর এবং সেই করের সঙ্গে আরও ৫ শতাংশ জরিমানা আরোপ করে যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, সেটা ঠিক আছে বলে আমি মনে করি।’
কালোটাকা মানেই যে অবৈধ অর্থ এমনটা নয়, সরকারকে হিসাব না দেয়া সব টাকাই ‘কালো’
অর্থনীতির আরও দুই গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানও একই কথা বলেন।
জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে, টাকা বিদেশে নিতে না পেরেই অনেকে সাদা করেছেন। তবে, একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, বিষয়টি কিন্তু দোষের নয়; সরকার সুযোগ দিয়েছে, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন তারা। এই টাকাটা যাতে বিনিয়োগে আসে, সেটা এখন নিশ্চিত করতে হবে।’
সেলিম রায়হান বলেন, ‘দেশে যে বিপুল অঙ্কের কালো টাকা আছে, আর সেই টাকা যে পাচার হয় সেটা কিন্তু এই উল্লস্ফনের মধ্য দিয়ে পরিস্কার হয়ে গেল। আমরা বার বার বলছিলাম, দেশ দেশে প্রতিবছর প্রচুর টাকা পাচার হয়, কিন্তু সরকার বিষয়টিকে আমলে নিচ্ছিল না, ব্যবস্থা নিচ্ছিল না। এখন কিন্তু সময় এসেছে, টাকা পাচারের বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বার বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশে বিনিয়োগ কিন্তু বাড়ছে না। কাজেই এ সুযোগ দিয়ে সৎ করদাতাদের কর দিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে কি না, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে সরকারকে।’
এবার কালো টাকা সাদা করার তালিকায় আছেন চিকিৎসক, সরকারি চাকরিজীবী, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক, ব্যাংকের উদ্যোক্তা মালিক, স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ আরও অনেকে।
বাংলাদেশে কত টাকা ‘কালো’ বা ‘অপ্রদরর্শিত’, অর্থাৎ আয়কর বিবরণীর ঘোষিত আয়ের বাইরে রয়ে গেছে- তা নিয়ে সাম্প্রতিক কোনো গবেষণা নেই৷
বিশ্বব্যাংক ২০০৫ সালের এক গবেষণায় বলেছিল, ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে কালোটাকার পরিমাণ ছিল মোট জিডিপির ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
২০১১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় কালোটাকা নিয়ে একটি জরিপ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ২০১০ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে কালোটাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৭ শতাংশ। আর ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে কালোটাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাংলাদেশে অবৈধ আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে মাদক চোরাকারবার, অবৈধ বাণিজ্য, ঘুষ ও দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছিল বিশ্ব ব্যাংক।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ‘কালো টাকা’একটি ‘ওপেন সিক্রেটে’পরিণত হয়েছে। ছোট চাকরি করলেও অনেকে বিলাসী জীবনযাপন করেন; ছেলে-মেয়েদের ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ান, বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন, দামি গাড়ি চালান। ঘুষ-দুর্নীতিসহ অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থসম্পদ নামে–বেনামে নানা পন্থায় লুকিয়ে রাখেন তারা।
সেই টাকা অর্থনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকার ‘সাদা’করার সুযোগ দেয়। কখনো ঢালাও সুযোগ, কখনো শর্ত সাপেক্ষে সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের দেয়া সেই সুযোগ খুব বেশি কাজে লাগান না কালোটাকার মালিকেরা। অনেকেই সেই টাকা দেশে না রেখে বিদেশে পাচার করে দেন।
কালোটাকা কী?
কালোটাকা মানেই যে অবৈধভাবে আয় করা- এমন নয়। মানুষের যে টাকার হিসাব আয়কর নথিতে উল্লেখ করা না হয়, সেটিই কালোটাকা।
দেশের মানুষের মধ্যে আয়কর নথি তৈরি না করার প্রবণতা আছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) রয়েছে ৬১ লাখের মতো। কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দেন মাত্র ২৫ লাখ। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩ লাখ রিটার্ন আছে যাদের আয় শূন্য। তাদের কাছ থেকে কোনো কর পায় না সরকার। ফলে নিয়মিত রিটার্ন দিচ্ছে মাত্র ২২ লাখ।
এই বাস্তবতায় যাদের করযোগ্য আয় আছে, অথচ হিসাব দেন না, তাদের পুরো অর্থই কালোটাকা। এ ছাড়া অবৈধ উপায় বা দুর্নীতির মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা হয়।
নতুন বাজেটেও আছে সেই সুযোগ, তবে এবার কর বেশি
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটেও কালোটাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ দিয়েছে সরকার। এবার বিনা প্রশ্নে ব্যাংকে নগদ জমা, নতুন শিল্পে বিনিয়োগ, পুঁজিবাজার, ফ্ল্যাট ও প্লট, ব্যাংক আমানতসহ বেশ কয়েকটি খাতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তবে, কর দিতে হবে বেশি।
তবে এখন কালোটাকা সাদা করতে হলে কর দিতে হবে ২৫ শতাংশ। সেই সঙ্গে করের ওপর জরিমানা গুনতে হবে ৫ শতাংশ।
৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে বাজেট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন, তাতে কালোটাকা হিসেবে অধিক পরিচিত ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’সাদা করার সুযোগের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
প্রস্তাবিত অর্থবিলেও তখন এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ না থাকলে কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ শেষ হচ্ছে বলে আলোচনা তৈরি হয়।
তবে বাজেট প্রস্তাবের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ বিষয়ে আলোচনার সুযোগ রেখে তা বহাল রাখার ইঙ্গিত দেন।
শেষ পর্যন্ত প্রচলিত নিয়মের বাইরেও বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে করের হার বাড়িয়ে এবং তার সঙ্গে আরও ৫ শতাংশ জরিমানা যোগ করে কোনো প্রশ্ন ছাড়া কালোটাকা সাদা করার ‘বিশেষ সুযোগ’দিয়ে অর্থ বিল ২০২১ সংসদে পাস হয়।