ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে তদারকির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো পুনর্গঠন করা হয়েছে।
ব্যাংক পরিদর্শনের চারটি বিভাগকে ভেঙে করা আটটি বিভাগ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে চারটি বিভাগে কাজ করতেন ৬ জন জিএম, এখন আটটি বিভাগে কাজ করবেন ৮ জন মহাব্যবস্থাপক।
এই বিভাগগুলোর প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, এই উদ্যোগে ব্যাংক খাতে অনিয়মের চেষ্টা শুরুতেই থামিয়ে দেয়া যাবে।
সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগে প্রশংসা করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে তিনি নিরপেক্ষভাবে চাপমুক্ত হয়ে তদারকির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সেই সঙ্গে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থার ওপরও তাগিদ দিয়েছেন।
নিউজবাংলাকে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক প্রধান বলেন, ‘ব্যাংকিং খাত দেখভাল খুবই টেকনিক্যাল কাজ। এ খাতকে আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে ঋণের গুণগত মান, খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি, পরিচালকদের বেপরোয়া ঋণ গ্রহণ এসব সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু সুপারভিশন বাড়ালে হবে না, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকার, গ্রাহক ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, ব্যাংকের ওপর জনগণের আস্থায় নড়চড় হলে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে।’
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলীও এই উদ্যোগকে সমর্থন করছেন। তিনি বলেন বলেন, ‘আগের তুলনায় ব্যাংক বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের শাখা, সেবার পরিধি বেড়েছে। সে হিসেবে সুপারভিশন বাড়ানো জরুরি ছিল। ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত অডিট, তদারকির মধ্যে থাকা প্রয়োজন। কারণ, সপারভিশন দেরি হলে ক্ষতি বেড়ে যায়। তদারকি, পরিদর্শন যত বাড়বে তত আর্থিক খাতে আরো শৃঙ্খলা তৈরি হবে।’
সার্কুলারে যা বলা আছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে ব্যাংক পরিদর্শন ও পরিপালন কার্যক্রম অধিকতর গতিশীল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের বিদ্যমান ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-১, ২, ৩ ও ৪ অবলুপ্ত করে নতুনভাবে ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ নামে ৮টি বিভাগ গঠন করা হয়েছে। এর কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিভাগগুলো এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
ব্যাংকগুলোর অনিয়মের ব্যাপারে নিয়মিত পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে কর্মী ও বিভাগের সংখ্যা কম থাকায় অনিয়ম ঠেকাতে কার্যকর তদারকি নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ জন্যই বিভাগ বাড়িয়ে নতুন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সব লোকবল। এসব বিভাগের ব্যাংকগুলো পরিদর্শনের আওতাও আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে।
উদ্যোগ হঠাৎ করেই নয়
এর আগে ৪ মে এ সংক্রান্ত দুটি সার্কুলার জারি করা হয়। সার্কুলারে ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের ৮টি বিভাগে যারা মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করবেন তাদের নাম উল্লেখ করা হয়। নতুন এ ব্যবস্থা গত ২৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়।
এর ফলে পরিদর্শন বিভাগের কর্মকর্তারা ব্যাংকগুলো পরিদর্শনের আরও বেশি ক্ষমতা পাবেন।
তদারকির নতুন কাঠামোর বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে অবহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে উপমহাব্যবস্থাপক, যুগ্ম পরিচালক, উপ পরিচালক ও সহকারী পরিচালকের পদ।
ব্যাংক তদারকি ও নীতি প্রণয়নে দায়িত্বে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি)। এ বিভাগের কার্যক্রম দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি অংশ নীতি প্রণয়ন করবে। অপর অংশ তদারকি করবে। আগে পুরো বিভাগের দায়িত্বে একজন মহাব্যবস্থাপক ছিলেন। এখন থাকবেন দুইজন। অন্যান্য জনবলও বাড়ানো হয়েছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তদারকিতে বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রযুক্তির ব্যবহারও করছে। নতুন কাঠামোতে সংশ্লিস্ট বিভাগগুলোর প্রযুক্তির সক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগকে পুনর্গঠন করেছে।
অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থতায় সমালোচনা
ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে কোনো ঘটনাই শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠেকাতে পারেনি। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধক কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও আছে আলোচিত পিপলস লিজিং কেলেঙ্কারিতে।
গত এক দশকে যতগুলো বড় বড় ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপের ৪ হাজার কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট গ্রুপের ৫ হাজার কোটি টাকা, অ্যাননটেক্স গ্রুপের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, সানমুন স্টার গ্রুপের ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে।
এসব ঘটনার বেশ কিছু আগেভাবে ইঙ্গিত পেলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা ঠেকাতে পারেনি। আর প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পরেও দায়ীদের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি, যাতে টাকা উদ্ধার করা যায়।
যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে, সেগুলোও নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এরপর থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইনি কাঠামো ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে শুরু করে। এরই অংশ হিসাবে এবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রধান দুটি বিভাগকে আরও শক্তিশালী করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে গত বছর করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে ব্যাংক খাত ঋণ বিতরণে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছে। প্রণোদনার ঋণ ছাড়া অন্য ঋণ বিতরণ হচ্ছে না বললেই চলে।
করোনার আগে বিশেষ সুবিধা দিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। তবে করোনাকালে কিস্তি পরিশোধে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। কিস্তি না দিলেও গত জুন পর্যন্ত ঋণখেলাপির তালিকায় নেয়া হয়নি কাউকে। এর মধ্যে আবার আগস্ট পর্যন্ত ২০ শতাংশ পরিশোধ করলেই এই সুবিধা পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও তাগাদা এসেছে। আর সরকারও এ বিষয়ে বিরোধীদের চাপে আছে।
আর্থিক খাতের ঝুঁকি নিয়ে আইএমএফের পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশের আর্থিক খাত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে মনে করে ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ)। 'ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর স্ট্যাবিলিটি রিভিউ ২০২০'-এ এটা উল্লেখ করা হয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সভায় জানানো হয়, আইএমএফ মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অটোনোমাস ক্যাপাসিটি ও সুপারভাইজারি অ্যাকশনে ঘাটতি আছে। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের খবরদারি সমালোচনা করে আইএমএফ এসব ব্যাংকের মালিকানা ও সুপারভিশন আলাদা করার তাগিদ দেয়। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোকে কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক- এই দুইভাগে ভাগ করতে বলেছে।
ওই সভায় বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজ উদ্যোগে আর্থিক খাতের ঝুঁকি চিহ্নিত করে তা দূর করতে নেয়া নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে আইএমএফকে বলবে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আর্থিক খাতের ঝুঁকি দূর করতে ২৮টি ক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব করেছে আইএমএফ। বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচটি ক্ষেত্রে সহায়তা নিতে পারে বলে সভায় জানানো হয়।