রাজধানীর বনশ্রী থেকে রিকশায় প্রাইম ব্যাংকের প্রগতি সরণি শাখায় এসেছেন শফিকুল ইসলাম। জরুরি প্রয়োজনে টাকা তোলা দরকার। কিন্তু ১১টার দিকে এসে দেখেন, ব্যাংকে তালা। ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী জানান, শাটডাউনের কারণে এই শাখার কার্যক্রম বন্ধ।
শাডটাউনের মধ্যে রাজধানীতে মাত্র ৯টি শাখা খোলা রেখেছে প্রাইম ব্যাংক। কিন্তু এই তথ্য জানেন না অধিকাংশ গ্রাহক। ব্যাংকের গেটে তালিকা দেয়া হলেও, খুদেবার্তা বা অন্য কোনো উপায়ে বিষয়টি গ্রাহককে অবহিত করা হয়নি।
গ্রাহক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শাটডাউনে বনশ্রীর মেরাদিয়া থেকে ৭০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে টাকা তুলতে এসে দেখি, নোটিশ দিয়েছে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ থাকবে এই শাখা। টাকা প্রয়োজন, তাই এখন গুলশান যেতে হবে।’
একই ব্যাংকে চেক জমা দিতে এসেছেন রিপন মিয়া। বলেন, ব্যস্ততম শাখা সত্ত্বেও এই শাখা বন্ধ রাখা ঠিক হয়নি। এখন কারওয়ান বাজার শাখায় গিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে। তারপরও আজ চেক জমা দেয়া যাবে কি না শঙ্কা আছে।
শুধু প্রাইম ব্যাংকই নয়, সব ব্যাংকেরই সব শাখা খোলা নেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ শাখার সামনে গ্রাহকের ভিড় বাড়তে দেখা যায়। অনেকে ব্যাংক বন্ধ পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলছেন, কোন কোন শাখা খোলা আগে থেকে কিছুই জানানো হয়নি। এভাবে ভোগান্তির কোনো মানে হয় না।
ব্যাংক এশিয়ার প্রগতি সরণি শাখা। সেখানেও গ্রাহকের জটলা, কারণ শাখাটি বন্ধ। এই শাখাটির গেটে বন্ধ বা খোলা শাখাগুলোর তালিকাও দেয়া হয়নি। নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে গ্রাহকরা জানতে পারেন, গুলশান শাখা খোলা। তাৎক্ষণিক তারা গুলশানের দিকে যান।
টানা চার দিন বন্ধ থাকার পর, সকাল থেকে আবারও খুলছে ব্যাংক। তবে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের কারণে লেনদেন হচ্ছে সীমিত পরিসরে। অর্থাৎ লেনদেনের সময় কমিয়ে সকাল ১০টা থেকে করা হয়েছে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত।
শাটডাউনের সময়টায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারের সঙ্গে রোববার ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ১ জুলাই বৃহস্পতিবার ছিল ব্যাংক হলিডে। ফলে সোমবার প্রতিটি শাখার সামনে ছিল ভিড়।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ব্যাংকের যেসব শাখা খোলা, সেসব শাখায় গ্রাহকের ভিড়। তবে, স্বাভাবিক দিনের চেয়ে ভিড় ছিল কম।
খোলা শাখায় মানা যাচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি
লেনদেনের সময় সীমিত এবং অল্পসংখ্যক শাখা খোলা থাকায় এক সঙ্গে ব্যাংকগুলোতে ভিড় করছেন গ্রাহক। দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন তারা। সম্ভব হয়নি সামাজিক দূরত্ব মানাও। এ পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন গ্রাহকদের পাশাপাশি ব্যাংককর্মীরাও।
স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। এ জন্য পরিস্থিতি বিবেচনায় সবার স্বার্থে সীমিত নয়, স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রাখা উচিত বলছেন গ্রাহক ও ব্যবসায়ীরা।
মতিঝিলের ডাচ বাংলা ব্যাংকের নজরুল ইসলাম নামে একজন গ্রাহক বললেন, ‘রাস্তায় কয়েক দফায় জবাবদিহি করার পর এই ব্যাংকে এসেছি। জরুরি ভিত্তিতে টাকা পাঠানো প্রয়োজন তাই আসা।’
মতিঝিলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রধান শাখাগুলোর লেনদেনও ছিল স্বাভাবিক। এসব শাখায় গ্রাহকের চাপ ছিল। ব্যাংকাররা জানান, অন্য দিনের চেয়ে চাপ কম। তবে, জরুরি প্রয়োজনে গ্রাহকরা আসছেন। টাকা উত্তোলন, জমা এবং বৈদেশিক লেনদেন সারতেও ব্যাংকমুখী হচ্ছেন গ্রাহকেরা।
সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসে দেখা গেছে, প্রতিটি কাউন্টারের সামনে গ্রাহকদের লাইন। ব্যবসায়িক খরচ, বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে নগদ টাকা তোলার প্রবণতা বেড়েছে। লেনদেনের সময় কম থাকার কারণে এই চাপ।
দিলকুশা এলাকায় আইএফআইসি ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রবিউল ইসলাম জানান, রামপুরা, বাড্ডা এলাকার ব্যাংকের শাখা খোলা নেই। তাই বাধ্য হয়ে দিলকুশা এসেছেন।
রূপালী ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে টাকা তুলতে আসা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও ব্যাংকের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকের ভেতর থেকে বলছে লোক কম তাই সময় বেশি লাগছে।’
ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানালেন, রোস্টার করে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। আগে ৪০ জন কর্মী কাজ করত। এখন কাজ করছে ২০ জন। গ্রাহকের চাপ বেশি থাকায় সেবা দিতে একটু সময় লাগছে।
গ্রাহকদের ভিড় দেখা যায় মতিঝিলির দিলকুশার সোনালী ব্যাংকের শাখায়ও। ছবি: নিউজবাংলা
বন্ধ শাখার সামনে গ্রাহকের ক্ষোভ
চার দিন বন্ধ থাকার পর সোমবার বাড্ডা, রামপুরা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংকে ভিড় করেন গ্রাহক। কিন্তু বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা বন্ধ পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।
প্রাইম ব্যাংক প্রগতি সরণি শাখায় আসা ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন জানান, সামনে ঈদ। কর্মীদের বেতন-বোনাস দেবেন কিন্তু এই সপ্তাহেও শাখা খোলা হবে না। এখন কী করবেন বুঝতে পারছেন না। সেলারি হিসাব হওয়ায় অন্য ব্যাংকেও যাওয়া যাচ্ছে না।
কোন কোন শাখা খোলা
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, রাষ্ট্র-মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার বিবেচনায় প্রতিটি জেলা সদরে ও উপজেলায় একটি করে শাখা খোলা রাখতে হবে।
অন্য সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রতিটি জেলা সদরে একটি শাখা খোলা রাখতে হবে। জেলা সদরের বাইরে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার বিবেচনায় অনধিক দুটি শাখা খোলা রাখা যাবে।
তবে রাজধানী ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো অন্য বড় শহরগুলোতে ব্যাংকের কয়টি শাখা খোলা থাকবে, সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তিতে খোদ ব্যাংকগুলোও।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবল বলেছে, যেসব শাখা বন্ধ থাকবে সেসব শাখার গ্রাহকদের সেবা দেবে খোলা অন্য শাখা। আর বন্ধ শাখায় দৃশ্যমান স্থানে বিজ্ঞপ্তি আকারে জানাতে হবে কোন কোন শাখা খোলা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহকদের অনলাইন ব্যাংকিংয়ে উৎসাহী করছে। কিন্তু বিশেষ করে প্রবীণরা এই ধরনের ব্যাংকিংয়ে অভ্যস্ত নন। আর প্রযুক্তি জ্ঞান যাদের নেই তারাও ব্যাংকে গিয়েই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রের মুনাফাসহ বিভিন্ন ভাতা উত্তোলন, রেমিট্যান্স, বেতনভাতা উত্তোলন, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল পরিশোধ বা ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে এখনও বহু মানুষ ব্যাংকে সশরীরে গিয়েই লেনদেন করেন।
আবার একটি জেলায় যদি বেসরকারি ব্যাংকের সব মিলিয়ে তিনটি শাখা খোলা থাকে, তাহলে কাউকে ব্যাংকে যেতে হলে দূরের উপজেলা থেকে বহু পথ পাড়ি দিতে হতে পারে।
বেসরকারি সিটি ব্যাংক ইতিমধ্যে ওয়েবসাইটে দিয়ে দিয়েছে বিধিনিষেধের সময় তাদের কোন কোন শাখা খোলা খাকবে।
ব্র্যাক ব্যাংক ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, সারা দেশে তাদের ৮০টি শাখা খোলা আছে। কোন কোন শাখা সেটা বিস্তারিত দেয়া আছে।
ট্রাস্ট ব্যাংকের সব শাখা খোলা থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যাংক ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। তবে সারা দেশে জোনাল অফিস প্রধানদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে।
প্রাইম ব্যাংকের প্রগতি সরণির শাখা বন্ধ। ঘুরে যেতে হচ্ছে গ্রাহকদের। ছবি: নিউজবাংলা
যা বলছেন ব্যাংকাররা
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরকার কঠোর লকডাউন ৭ জুলাই পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। গ্রাহকদের স্বার্থে জরুরি সেবার আওতায় সীমিত আকারে ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে। ঈদের আগে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে গ্রাহকদের। তারপরও অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম বুথ এবং মোবাইল ব্যাংকিং স্বাভাবিক রাখতে বলা হয়েছে। যাতে গ্রাহকদের কোনো সমস্যা না হয়।
কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রাধানিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সব শাখা অনলাইন সেবা চালু আছে। বিধিনিষেধে মানুষের চলাচলও তেমন থাকবে না। বর্তমানে বেশির ভাগ গ্রাহকই টাকা জমা ও উত্তোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এ কারণে এটিএম বুথগুলোতে পর্যন্ত টাকা সরবরাহ করা হয়েছে। এতে গ্রাহকের সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের প্রিন্সিপাল অফিসার এফ এম মাসুম বলেন, ‘আমাদের লোকাল অফিসে সব সময় ভিড় লেগেই থাকে। আর চার দিন বন্ধের পর সোমবার খুলছে। ফের গ্রাহকদের সেবা দিতে হিমশিম অবস্থা। সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে মানতেও চান না। এতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।’
জনতা ব্যাংক করপোরেট শাখার কর্মকর্তা এস এম সাদেকুর রহমান বলেন, ‘শাখা খোলা রাখার অর্থ ব্যাংকারদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকও ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে কিছু দিনের জন্য হলেও ব্যাংক বন্ধ রাখাই ভালো ছিল।’