চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের পাশাপাশি বিদেশ থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। ২৫ শতাংশ কর আরোপ করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় শিগগিরই সেদ্ধ চাল আমদানি করা হবে জানান মন্ত্রী।
রাজধানীর মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবন থেকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘দেশের সামগ্রিক খাদ্যশস্যের ব্যবস্থাপনা’-সংক্রান্ত সভায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে মন্ত্রী এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘কোনোভাবেই চালের বাজার অস্থিতিশীল হতে দেয়া হবে না। অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহ জোরদার করার পাশাপাশি বিদেশ থেকেও চাল আমদানি করা হবে। ২৫ শতাংশ কর আরোপ করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় শিগগিরই নন-বাসমতী সেদ্ধ চাল আমদানি করা হবে।’
ধানের অবৈধ মজুতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রান্তিক কৃষক অনেক আগেই ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। মিলমালিকরা বলছেন, অতিরিক্ত লাভের আশায় কৃষক নন এমন অনেকেই ধান মজুত করছেন। কেউ যদি অবৈধ মজুত করে থাকেন, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’
এই সিদ্ধান্ত এমন সময় নেয়া হলো, যখন দেশে ধান উৎপাদনের প্রধান মৌসুম ইরি-বোরো ঘরে তুলছেন কৃষক। এ সময় আমদানি হলে ধান-চালের দাম কমে যেতে পারে। এতে কৃষকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে খাদ্যমন্ত্রীর কথায়ই সমর্থন দেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। সরকারি চাল সংগ্রহের পাশাপাশি যেসব দেশে চালের দাম কম, সেখান থেকে আমদানি করে বাজার স্থিতিশীল রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পেয়েছেন। এখন আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে প্রকৃত কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।’
প্রতিনিয়ত কৃষিজমি কমছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য চাহিদার সঠিক পরিসংখ্যান দরকার।’
খাদ্য চাহিদার সঠিক পরিসংখ্যানের ওপর গুরুত্ব দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, ‘খাদ্য চাহিদার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলে বেশি আমদানি কৃষকের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। আবার কম আমদানি ভোক্তার জন্য কষ্টের কারণ হতে পারে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ আমাদের। কৃষির পাশাপাশি শিল্পকারখানা বাড়িয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।’
এ সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মেজবাহুল ইসলাম, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমানারা খানুম, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি বিশ্বাস, কৃষি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ এবং খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ মুজিবুর রহমান।
খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সভায় যুক্ত ছিলেন।
এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চাল আমদানি পরিস্থিতির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে বেসরকারি পর্যায়ে দৈনিক ১০ হাজার ৮৭০ টন হারে মোট ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩০ টন চাল আমদানি হয়েছে।
গত অর্থবছরে বেসরকারিভাবে মোট ৩২০ জন আমদানিকারককে ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। কিন্তু অনুমতিপ্রাপ্তরা এলসি খোলার সময়সীমা দুবার বাড়ানোর সুযোগ পেয়েও ফেব্রুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত অনেকে এলসি খোলেননি। আবার যারা খুলেছেন, তাদের অনেকে চাল আমদানি করেননি। কেউ কেউ করলেও পরিমাণ প্রত্যাশিত ছিল না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯০০ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে, চলতি বোরো মৌসুমে দেশে ধানের জমিতে কয়েক ঘণ্টার হিট শক বয়ে গেছে। এতে ২১ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। তবে আশার খবর, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭৮ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ধানের ফলন প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
ফলে ধানের সার্বিক উৎপাদন এবার গতবারের তুলনায় না কমে উল্টো লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। সামনে প্রকৃতি খারাপ থাকলেও সেটি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিই থাকবে।
এ পরিস্থিতিতে কৃষকের ধানের দাম পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই জানিয়ে খাদ্যসচিব ড. নাজমানারা খানুম বলেন, সরকার দেশে ধান-চালের যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।
সরকার চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে ৬ লাখ টন ধান এবং সাড়ে ১১ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে। সরকার কৃষকের কাছ থেকে কেজিপ্রতি ২৭ টাকা দরে ধান, আর কেজিপ্রতি ৪০ টাকা দরে ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং ৩৮ টাকা দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল কিনছে চালকলমালিকদের কাছ থেকে। এই দাম গত বছরের তুলনায় কেজিপ্রতি যথাক্রমে এক টাকা ও তিন টাকা বেশি।
গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান কেনা শুরু হয়েছে। চাল সংগ্রহের অভিযান শুরু হয়ে গেছে ৭ মে থেকে। চলবে আগামী আগস্ট মাস পর্যন্ত।