একটি দেশের অর্থনীতির হালচাল কেমন, তা বোঝা বা জানার জন্য দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির দিকে তাকালেই পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির বাস্তব চিত্র এখন কেমন, তা বোঝার জন্য ফিরে যেতে হবে দুই বছর পেছনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে।
ওই বছরের পর জিডিপি প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত কোনো হিসাব প্রকাশ করেনি সরকার। এর মধ্যে দুটি অর্থবছর (২০১৯-২০ ও ২০২০-২১) শেষ হয়ে গেল। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছে এক বছর আগে। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হবে চার দিন পর ৩০ জুন। কিন্তু এই দুই বছরে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গেল।
গত ১১ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে দেশে। গত বছরের ১০ আগস্ট আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তথ্য হিসাব করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এই তথ্যই প্রকাশ করেছিল। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেনি বিবিএস।
বিবিএসের মহাপরিচালক (ডিজি) তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। ২০২০-২১ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবও প্রকাশ করা হয়নি।’
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে ঘোষণা দিয়েছেন, সে তথ্য তিনি কোথায় পেয়েছেন।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার শেষের দিকে ১৬৩ পৃষ্ঠায় সারণি-৩ এ ‘এক দশকে অর্জন’ শীর্ষক যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে অবশ্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে তথ্য আছে, তা সাময়িক তথ্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই সারণিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৮ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে আনার তথ্য দেয়া হয়েছে। শেষ হয়ে গেলেও বিদায়ী অর্থবছরের জিডিপি নিয়ে এখন পর্যন্ত সাময়িক বা প্রাথমিক কোনো হিসাবই প্রকাশ করেনি বিবিএস।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিগত এক দশকে বাংলাদেশের উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন কোভিড মহামারির প্রভাবে সাময়িক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তা হ্রাস পেয়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়ায়।
‘তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে কোভিড-১৯ এর প্রভাব হতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে ধরে নিয়ে বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু মহামারির প্রভাব দীর্ঘতর হওয়া, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এবং পুনরায় লকডাউন ঘোষণার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্লথ অবস্থা বিরাজমান এবং রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত গতি ফিরে আসেনি।
‘তবে প্রবাসী আয়ে গতিশীলতা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নকে হিসাবে ধরে বিদায়ী অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘পাশাপাশি কোভিড পরবর্তী উত্তরণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।’
সরকারিভাবে দাবি করা হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ২২৭ ডলার হয়ে ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই দুই বছরে বাংলাদেশের জিডিপির হিসাব চূড়ান্ত করতে পারেনি বিবিএস। ফলে প্রায় দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাস মহামারি দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে – তার প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে এর আগে কখনই এমনটি হয়নি। সাধারণত, প্রতি বছর এপ্রিল-মে মাসের দিকে ওই অর্থবছরের আট-নয় মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জিডিপির একটি সাময়িক হিসাব তৈরি করে থাকে বিবিএস। পরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দিকে পুরো অর্থবছরের তথ্য-উপাত্ত হাতে পেয়ে জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব করা হয়। কিন্তু গত অর্থবছরের জিডিপি গণনায় দুটির কোনোটিই করা হয়নি।
২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হওয়ার দেড় মাসের মাথায় গত আগস্ট মাসে একটি সাময়িক হিসাব দিয়ে বিবিএস বলেছিল, ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা নিয়ে তখনই প্রশ্ন তোলেন অর্থনীতিবিদেরা।
ওই সময়ের মধ্যে রাজস্ব, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি ব্যয়সহ অর্থনীতির প্রায় সব খাতের পুরো অর্থবছরের (জুলাই-জুন) তথ্য-উপাত্ত চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিবিএস আট-নয় মাসের তথ্য-উপাত্ত দিয়েই সাময়িক হিসাব প্রকাশ করে। তাতে করোনার প্রভাব ধরা হয়নি।
এদিকে চলতি ২০২০–২১ অর্থবছর শেষ হতে আর সপ্তাহখানেকও বাকি নেই; অথচ বিবিএস এখনও ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাবই তৈরি করতে পারেনি। অন্যান্যবার এই সময়ের আগেই চলমান অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এবার সেই কাজ শুরু করা যাচ্ছে না আগের বছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব না থাকায়।
গত ১৭ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক এক বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, দেশে মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার হয়েছে।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী মাথাপিছু আয়ের এ তথ্য দিয়েছেন।
এতদিন মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। সে হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬৩ ডলার।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, আগে যা ছিল ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।
পরের দিন ১৮ মে সাংবাদিকরা পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে জিডিপির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিবিএস তাকে এই তথ্যই দিয়েছে। এর বাইরে তার কাছে কোনো তথ্য নেই।
এ বিষয়ে বিবিএসের মহাপরিচালক (ডিজি) তাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব এখনও হয়নি। বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবও হয়নি।
২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব কবে প্রকাশ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নতুন কিছুই হয়নি। আগে যেটা ছিল, মন্ত্রী মহোদয় যেটা বলেছিলেন, সেটাই আছে। নতুন কিছু হলে মাননীয় মন্ত্রী অবশ্যই জানাবেন।’
জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ না করায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এভাবে হিসাব প্রকাশ না করে সরকার কী মজা পাচ্ছে, আমার মাথায় ঢুকছে না। মহামারির এই কঠিন সময়ে যেটাই অর্জিত হোক না কেন, সেটা প্রকাশ না করে গড়িমসি করায় আরও নানান প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
‘বিবিএসের জিডিপির তথ্য নিয়ে সব সময়েই প্রশ্ন ওঠে। এবার প্রকাশ না করে তারা সে সব প্রশ্নকে আরও উসকে দিচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মহামারির এই সঙ্কটকালে কোনো অবস্থাতেই ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরেও ৩/৪ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।
‘আমরা সবাই জানি, একটি কঠিন সময় পার করছি আমরা। এই সময়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাইটাই যথেষ্ঠ; ১/২ শতাংশও যদি প্রবৃদ্ধি হয়, সেটাও ভালো। প্রকাশ করতে সমস্যা কোথায়, সেটাই আমি বুঝছি না।’
তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রকৃত হিসাব না পাওয়া গেলে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝা যায় না। পরিকল্পনা গ্রহণেও সমস্যা হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব নিয়ে প্রশ্ন
সাধারণত সাময়িক হিসাবে একটি খাতের আট-নয় মাসের প্রকৃত তথ্য-উপাত্তকে প্রবণতা হিসেবে ধরে পুরো বছরের চিত্র দেখানো হয়। কিন্তু গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের সাময়িক প্রবৃদ্ধির হিসাবে কিছু খাত নিয়ে প্রশ্ন আছে। যেমন গত বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। এরপর এপ্রিল ও মে মাস বাস, ট্রাক, ট্রেন, ট্রলার, লঞ্চ, ব্যক্তিগত গাড়িসহ সব ধরনের যান চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল। আকাশে ডানা মেলেনি বিমান।
অর্থবছরের ৪ ভাগের ১ ভাগ সময় পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকলেও পরিবহন খাত সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে ৫ হাজার ৮৮ কোটি টাকার অবদান রেখেছে বলা হয়।
করোনা শুরুর কয়েক মাস কক্সবাজারসহ দেশের পর্যটন স্পটগুলো প্রায় পর্যটকশূন্য ছিল। করোনার কারণে প্রথম তিন মাস পর্যটন এলাকার সব হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল। অথচ বিবিএসের হিসাবে বলা হয়, অর্থবছর শেষে জিডিপিতে হোটেল-রেস্তোরাঁর অবদান ৫০৯ কোটি টাকা বেড়েছে।
জিডিপিতে নির্মাণ খাতের অবদান প্রায় ৮ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাতের অবদান ৮৮ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। নির্মাণ খাতের সিংহভাগ অবদান আসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের মাধ্যমে। গত অর্থবছরে এডিপির টাকা খরচ আগেরবারের চেয়ে ৫ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা কমেছে। কিন্তু বিবিএস বলছে, ওই অর্থবছরে জিডিপিতে নির্মাণ খাতে মূল্য সংযোজন বেড়েছে ৭ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।
করোনাকালে ফ্ল্যাট বিক্রি তেমন একটা হয়নি। কিন্তু বিবিএস বলছে, আবাসন খাতের অবদানও ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়েছে।