দেশে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবসার পরিপ্রেক্ষিতে ‘আগে পণ্য, পরে টাকা’ বলে যে নীতি ঘোষিত হয়েছে, সেটি বিদেশি ই-কমার্স সাইটগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তারা আগেভাগে টাকা নিয়ে পরে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেল এবং ইলেকট্রনিকস কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)।
বৃহস্পতিবার সরকার অনলাইন কেনাকাটায় নতুন এই নিয়ম চালু করে।
কিন্তু বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে লেনদেনে একই নিয়ম চালু হবে কি-না এ-সংক্রান্ত কোনো কিছু নতুন ওই সিদ্ধান্তে স্পষ্ট ছিল না। ফলে বিদেশি কেনাকাটায়ও যদি এই অভিন্ন নিয়ম চালু করা হয়, দেশে এর প্রভাব কী হবে ক্রেতাদের মনে এমন সংশয়ও তৈরি হয়।
রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলো নিউজবাংলাকে জানিয়েছে, বাংলাদেশের কোনো ক্রেতা বা মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠান যদি বিদেশি কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্যের অর্ডার করতে চায়, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের চালু করা ‘আগে পণ্য, পরে টাকা’ এই নতুন নিয়ম তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। বরং সংশ্লিষ্ট বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতার কাছে যে পণ্যের জন্য যেভাবে মূল্য পরিশোধের অফার করবে সেই নিয়মই বহাল থাকবে।
বাংলাদেশে বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চীনের আলিবাবা, টেন সেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের অ্যামাজন, ফেসবুক, ইউরোপের কিউভি, ভারতীয় ফ্লিপকার্টসহ আরও কয়েকটি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে।
শুধু সাধারণ ক্রেতা নয়, দেশি অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানও পণ্যের চাহিদা মেটাতে বিদেশি এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু তারা কখনও পণ্য পাঠিয়ে পরে টাকা নেয় না। বরং আগে টাকা পরিশোধ করতে হয়, পরে তারা পণ্য পাঠায়। টাকা নিয়ে পণ্য না দেয়ার অভিযোগও আছে। যদিও বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ নেই।
- আরও পড়ুন: আগে পণ্য পরে টাকা: স্বাগত জানাল কিউকম
এসব প্রতিষ্ঠানের দেশে কোনো অফিস বা এজেন্সি নেই। এ দেশে তাদের পণ্য উৎপাদন তো দূরের কথা, চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত সরবরাহ করার জন্য পণ্যের বাফার মজুতের জন্য নিজস্ব কোনো ওয়্যারহাউস বা গুদামও নেই।
দেশি ক্রেতা বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অর্ডার সাপেক্ষে পণ্যের বিপরীতে মূল্য পরিশোধ হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গেটওয়ে সিস্টেমে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং চ্যানেল কিংবা ক্রেডিট কার্ড, মাস্টারকার্ড বা ভিসাকার্ডের মাধ্যমে। এর মানে হচ্ছে- আগে ক্রেতারা যেভাবে এসব বিদেশি অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে লেনদেন করে আসছে, আগামীতেও সেভাবেই চলবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক ও (অতিরিক্ত সচিব) হাফিজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রেগুলেটরি বডি এবং খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা শুধু দেশের ডিজিটাল বাণিজ্যকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, ক্রেতার স্বার্থরক্ষা এবং ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মেজবাউল হক বলেন, ‘বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো তো বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের নয়। সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা শুধু দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। সেখানে পেমেন্টের ক্ষেত্রে আগে যেভাবে চলে আসছে সেভাবেই চলবে।’
- আরও পড়ুন: আগে পণ্য পরে টাকা: ই-নিডজ আপাতত বন্ধ
ই-কমার্স সাইটগুলোর সংগঠন ই-ক্যাব (ইলেকট্রনিক কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহাব উদ্দিন শিপন বলেন, ‘আলিবাবা, অ্যামাজান ফ্লিপকার্টের মতো সাইটগুলো তো বাংলাদেশের নয়। তাই ই-কমার্স বাণিজ্য পরিচালনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তার আওতা ওইসব প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়বে না। তারা যে পণ্যের জন্য যেভাবে ক্রেতার কাছে আসবে-সংশ্লিষ্ট ক্রেতাকে সেভাবেই সাড়া দিতে হবে। পেমেন্টও আগের নিয়মেই থাকবে।’
ই-ক্যাব সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল মনে করেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেনের বিষয়টি অদূর ভবিষ্যতে কী হবে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক-বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কারণ, সেখানেও আগে টাকা নিয়ে অনেক সময় পরে পণ্য পাঠানোর ঘটনা আছে।
যে কারণে বিধিনিষেধ
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু এমন ই-কমার্স সাইট তৈরি হয়েছে, যেগুলো গ্রাহকদের অবিশ্বাস্য ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রি করছে। তবে কোম্পানিগুলোকে আগে টাকা পরিশোধ করতে হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর পণ্য সরবরাহ করে।
তবে টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহে বারবার সময়ক্ষেপণের অভিযোগ আছে। আবার তাদের ব্যবসার কৌশলটিও স্পষ্ট নয়। এ কারণে নানা সন্দেহ-সংশয় আছে জনগণের মধ্যে।
এর মধ্যেই কমার্স সাইট ইভ্যালিকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি তদন্ত চালিয়েছে; যাতে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি এক টাকা আয় করতে সাড়ে তিন টাকার বেশি ব্যয় করে। আবার তাদের সম্পদের তুলনায় দেনা ছয় গুণ। ফলে তারা এই টাকা আদৌ পরিশোধ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
এর মধ্যে তিনটি ব্যাংক তার গ্রাহকদের জানিয়ে দিয়েছে কার্ড দিয়ে ১০টি ই-কমার্স সাইটে টাকা পরিশোধ করতে পারবে না। আরও দুটি ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের সতর্ক করেছে।
এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ই-কমার্স ব্যবসা নিয়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কোনো প্রতিষ্ঠান পণ্য পৌঁছে দেয়ার আগে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা পাবে না।
ক্রেতার অর্ডার করা পণ্য হাতে না পাওয়া পর্যন্ত ওই পণ্যের পেমেন্ট সংশ্লিষ্ট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা হবে না। এ জন্য পণ্য অর্ডারের বিপরীতে পরিশোধিত টাকা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সরকার কর্তৃক অনুমোদিত মিডলম্যান প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা জমা থাকবে।
অর্ডার করা পণ্য ক্রেতা হাতে পাওয়ার পর ডেলিভারিম্যানের কাছে দেয়া স্বাক্ষরযুক্ত রিসিভ কপি জমা দিলেই পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে টাকা ছাড় হবে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গেটওয়ে সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে করা হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে এই বক্তব্য আসার পর দুটি ই-কমার্স সাইট একে স্বাগত জানিয়েছে। ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘গণমাধ্যমের সূত্রে বিষয়টি আমরা জেনেছি। বিষয়টিকে আমরা স্বাগত জানাই। এ ছাড়া শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি পরিচালন নির্দেশিকা করা হবে, যাতে পণ্য ডেলিভারির আগে পেমেন্ট নেয়া না হয়। ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ড যাদের আছে, তারা পেমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করবে।’
ই-কমার্স নিয়ে নীতিমালা জরুরি বলে মনে করেন রাসেল নিজেও। বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ই-কমার্স নীতিমালা নেই। ইভ্যালি নিজেও দীর্ঘদিন এই নীতিমালার কথা বলে আসছে।’
আরেক ই-কমার্স সাইট কিউকমের সিইও রাসেল মিয়াও স্বাগত জানিয়েছেন সরকারি উদ্যোগকে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের অভিভাবক। তারা আমাদেরকে গাইডলাইন দেবে। তারা অনেক নীতিমালার কথা বলবে। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমান বিজনেস পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হবে। একটা আইডিয়া এসেছে। আবার আলোচনায় বসলে নতুন কোনো আইডিয়া আসতে পারে।’
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য আসার পর আরেক সাইট ই নিডস তাদের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রেখেছে। সরকার আসলে কী করতে চায়, সেটি দেখেই তারা কার্যক্রম আবার শুরু করার কথা জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমরা সরকার তথা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের পথচলার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের গ্রাহক ও সেলারদের সহযোগিতা ও ভালোবাসা যেভাবে পেয়েছি সেটা অব্যাহত থাকবে। আমরা কথা দিচ্ছি খুব শিগগিরই সরকারের সব সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে একাগ্রতা প্রকাশ করে নতুন আঙ্গিকে গ্রাহকের জন্য সেবা নিয়ে আসব।’