সিনেমা হল তৈরি, সংস্কারের জন্য এক হাজার কোটি টাকার তহবিল নিয়ে বসে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ঋণ নিতে কেউই আগ্রহী নয়।
গত বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল, চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য বিশেষ তহবিল করবেন তিনি। এরপর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি এই তহবিল করার কথা জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানানো হয়, প্রথমে দেয়া হবে ৫০০ কোটি টাকা, এরপর চাহিদা থাকলে দ্বিতীয় ধাপে দেয়া হবে আরও ৫০০ কোটি টাকা।
তহবিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক জোগান দিলেও ঋণ দেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক। তবে গত চার মাসে কোনো ব্যাংক থেকে একটি আবেদনও পড়েনি। ঋণ নেয়ার সময় আছে আর ৯ মাস।
এই বিশেষ তহবিল থেকে ঋণ পাওয়া যাবে ৪ শতাংশ সুদে। তবে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চাইছেন, সুদহার আরও কমিয়ে ২ শতাংশ করা হোক।
আবার শিল্প টিকিয়ে রাখতে ঋণ নয়, অনুদান দেয়ার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
নব্বইয়ের দশক থেকে চলচ্চিত্রশিল্প জৌলুস হারাতে শুরু করে। জেলায় জেলায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল। করোনা পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রে হয়েছে নতুন অনুঘটক। সিনেমা হল চালানোর চেয়ে বিপণিবিতান বা অন্য প্রতিষ্ঠান করলে আয় ভালো হয়। তাই হলের মালিকরা হাঁটছেন ওই পথেই।
তবে হলের পরিবেশ ভালো হলে আর যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিনেমা চালালে যে মুনাফা ভালোই হয়, তা দেখিয়েছে স্টার সিনেপ্লেক্স আর যমুনার মাল্টিপ্লেক্স। তবে করোনা পরিস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠানও ভালো নেই। তাই অন্যরা এই মুহূর্তে বিনিয়োগে যেতে চাইছেন না।
সিনেমা হল তৈরি, সংস্কারের জন্য এক হাজার কোটি টাকার তহবিল রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। ফাইল ছবি
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আবেদন করার এখনও অনেক সময় আছে। গত কয়েক মাসে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এখন আগের চেয়ে আরও সতর্ক হয়েছে।’
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আরফান আলী বলেন, ‘সাধারণত চলচ্চিত্রশিল্পে বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা নেই ব্যাংকগুলোর। এ কারণে ব্যাংকগুলো এমন ঋণে স্বস্তিবোধ করছে না।’
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল নিউজবাংলাকে জানান, তহবিল গঠনের পর সুদহার ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করা হয়েছে।
ঋণ মিলবে যে যে খাতে
চলচ্চিত্রের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সিনেমা হলগুলোর জন্য এক হাজার কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, সিনেমা হল সংস্কার, আধুনিকায়ন ও মেশিনারি, যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি ক্রয় এবং নতুন সিনেমা হল নির্মাণের উদ্দেশে এই তহবিল থেকে ঋণ মিলবে।
বিভিন্ন শপিং কমপ্লেক্সে বিদ্যমান সিনেমা হলসহ নতুনভাবে নির্মিত সিনেমা হলগুলোও এই তহবিলের আওতায় ঋণসুবিধা পাবে।
তহবিলের আওতায়ে একজন সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবে।
ঋণের সুদে ছাড়
সার্কুলারে বলা হয়, বিভাগীয় শহরের জন্য এই ঋণের সুদহার ৫ শতাংশ ও এর বাইরের এলাকার জন্য সাড়ে ৪ শতাংশ। আর এই ঋণ শোধ করা যাবে আট বছর পর্যন্ত। প্রথম বছরে ঋণ পরিশোধে ছাড় মিলবে (গ্রেস পিরিয়ড)।
তবে চলতি মূলধন বাবদ কোনোরূপ ঋণ দেয়া হবে না। এ ছাড়া এ তহবিলের আওতায় গৃহীত ঋণ দিয়ে কোনোভাবেই অন্য কোনো ঋণের দায় শোধ করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে এই পুনঃ অর্থায়নের অর্থ দেবে।
মূলত ব্যাংকগুলো এই ঋণ প্রদান করবে, এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃ অর্থায়ন নিতে পারবে। আর সময়মতো ঋণ শোধ না করলে ব্যাংকগুলোর হিসাব থেকে কেটে নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বিচার-বিবেচনা করে ব্যাংকগুলোকে এই ঋণ দিতে হবে।
তহবিলে কেন অনীহা
ব্যাংক এশিয়ার এমডি মো. আরফান আলী নিউজবাংলাকে বলেন, শিল্প খাত হিসেবে চলচ্চিত্র খাতে ব্যাংকারদের জানাশোনা অনেক কম। এ জন্য এ খাতের ঋণ বিতরণেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না বেশির ভাগ ব্যাংক।
তিনি বলেন, শুধু ঋণ দিলেই হবে না, ব্যাংকগুলোকে টিকে থাকতে হলে সেই ঋণের অর্থ আবার ফেরত আনতে হবে।
প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল নিউজবাংলাকে বলেন, সার্কুলারে বলা হচ্ছে ঋণ পরিশোধে সময় পাওয়া যাবে ৮ বছর। এটা ১২ বা ১৫ বছর করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ‘ঋণ নিতে জায়গা মর্টগেজ দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল। এটা শিথিল করার অনুরোধ করেছি। কোনো ব্যাংক না দিতে চাইলে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখবে। কারণ, এটা সরকার ঘোষিত তহবিল।’
পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার নিউজবাংলাকে বলেন, সিনেমা হলমালিকদের ঋণ দেয়া হলেও সিনেমা তৈরির জন্য তহবিল প্রয়োজন। শুধু হল নির্মাণ করলে হবে না, সিনেমাও তো লাগবে। এ জন্য এফডিসির মাধ্যমে এ খাতে অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন।
এ জন্য শুধু হলমালিকদের না চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরও স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। যে ঋণ এফডিসির মাধ্যমে চলচ্চিত্রের নিয়মিত পরিচালকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। তাতে করে হলমালিকরা ভালো ছবি পাবেন এবং দর্শক হলে ফিরতে শুরু করবে।
তিনি বলেন, রুগ্ণ চলচ্চিত্রশিল্পকে টেনে তুলতে ঋণ দিয়ে তেমন সফলতা আসবে না। ওই তহবিল অনুদান হিসেবে বিতরণ করা হলে চলচ্চিত্রপাড়ায় সুদিন ফিরতে পারে।
বহুবিধ সংকটে এই শিল্প
করোনাকালে সিনেমা হল বন্ধ ছিল টানা সাত মাসের বেশি। এরপর গেল বছরের অক্টোবরে হল খুলে দেয়ার পরও অধিকাংশ হলের মালিক হল খোলেননি।
হলমালিকরা বলছেন, দীর্ঘদিন হল বন্ধ থাকলেও বিদ্যুৎ বিল, কর্মীদের বেতন-ভাতা সবই দিতে হয়েছে। অনেক মালিক ভাড়া করে হল চালান, তাদের প্রতি মাসে উচ্চমূল্যের ভাড়া গুনতে হয়েছে।
১৯৫৪ সালে শুরু হওয়া মধুমিতা সিনেমা হলটি মাগুরা জেলার প্রথম হল। দেনার দায়ে যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন হলটির মালিক বাবুল মিয়া। ছবি: নিউজবাংলা
নব্বইয়ের দশকে দেশে প্রায় দেড় হাজার সিনেমা হল চালু ছিল। বিভিন্ন সংকটে বন্ধ হতে হতে বর্তমানে মাত্র ১৫০টি হল চালু আছে। তবে এসব হলেও তেমন দর্শক মিলছে না। মূলত উন্নত প্রদর্শনকেন্দ্র না থাকা এবং ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি এতই নাজুক যে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত আসবে কি না, এমন অনিশ্চয়তায় করোনার গত এক বছরে নতুন সিনেমা নির্মাণের সাহস পাচ্ছেন না কেউ।
২০১২ সালের ৩ এপ্রিল চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত এ খাত শিল্প হিসেবে কোনো সুবিধাই পায়নি। ফলে এই শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বেশির ভাগ মানুষ।