করোনাকালে অর্থনীতির দুর্দিনে এক অনন্য নজির দেখাল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি ব্যাংক।
মহামারির মধ্যেও নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যখন ব্যাংকের সার্বিক খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বেড়েছে, তখন ব্যাংক এশিয়া উল্টো ১৭৫ কোটি টাকা আদায় করেছে।
গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটির কোনো গ্রাহকের নাম খেলাপির খাতায় ওঠেনি। উল্টো বেশ কয়েকজন গ্রাহক কিস্তি পরিশোধ করে তাদের ঋণ নিয়মিত করেছেন।
মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক এশিয়ার বিতরণ করা মোট ঋণ ২৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৬১৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৭৯৩ কোটি টাকা, যা ওই সময় বিতরণকৃত ঋণের ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ ছিল।
অর্থাৎ ব্যাংকটি তার মোট খেলাপি ঋণের ২২ শতাংশ এই তিন মাসেই আদায় করতে পেরেছে।
মার্চ মাস শেষে দেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ০৭ শতাংশ।
ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
সেই হিসাবে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা।
মার্চ শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে এ সময়ে সাতটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। আর ৫০টি ব্যাংকের বেড়েছে। আর অপরিবর্তিত রয়েছে সরকারি বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ।
এই ছয়টি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আরফান আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ সুবিধা (ডেফার্ড বা অতিরিক্ত সময়) দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু ভালো গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করছেন। আবার কেউ কেউ আরও সুযোগ-সুবিধা খুঁজছেন।’
রাজধানীর পুরানা পল্টনে ব্যাংক এশিয়ার প্রধান কার্যালয়। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘নতুন কোনো খেলাপি হয়নি। কারণ কিস্তি পরিশোধে কিছু ছাড় চলছে। অনেক গ্রাহক এ সুবিধা নেয়ার কারণে নতুন করে খেলাপি হয়নি। পুরাতন ঋণের মধ্যে অনেক গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেছেন। নতুন খেলাপি না হওয়া আর পুরান ঋণ আদায়ের কারণে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ আদায় কিছুটা বেড়েছে।’
সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে অভিজ্ঞ এই ব্যাংকার বলেন, ‘এগুলোর বেশিরভাগই মন্দ মানের ঋণ। এসব ঋণের এক কিস্তি দিতে না পারলেই মন্দ মানের খেলাপিতে পরিণত হয়।’
তবে কোনো ঋণখেলাপি টাকা পরিশোধ না করে সামনে যেতে পারবে না। এই বিষয়টা বারবার মনে করিয়ে দেয়া উচিত বলেও তিনি মনে করেন।
সাফল্য দেখিয়েছে অন্য আরও ছয়টি ব্যাংক।
১. ডাচ্-বাংলা
শতকরা হারে এই ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ সবচেয়ে কম। এদের মোট বিতরণ ২৭ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ৬৫৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৯২ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময় বিতরণ করা ঋণের ২ দশমিক ১৭ শতাংশ।
এই ব্যাংকটিও তিন মাসে ৫৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছে।
জনতা
মার্চ শেষে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ ৫৭ হাজার ৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১৩ হাজার ৫৭০ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
তবে ডিসেম্বরের তুলনায় খেলাপি ঋণের পরিস্থিতিটা কিছুটা হলেও ভালো দেখাচ্ছে।
সে সময় ছিল ১৩ হাজার ৬২২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। তিন মাসে ব্যাংকটি ৫১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা আদায় করেছে।
সোনালী
মার্চ শেষে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ ৫৩ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।
ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল আরও বেশি ১০ হাজার ৭২১ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
তিন মাসে ব্যাংকটি ৩২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আদায় করেছে।
ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তান
এ ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের প্রায় পুরোটাই খেলাপি। মার্চ শেষে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ ১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৯৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
প্রায় সব টাকাই খেলাপিতে পরিণত হওয়া ব্যাংকটি তিন মাসে ১৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আদায় করেছে।
ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক
বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই খেলাপিতে পরিণত। মার্চ পর্যন্ত মোট ঋণ ৮৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৬৬৯ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে এই হার ৭৮ দশমিক ১৮ শতাংশ।
তবে ডিসেম্বরের পরিসংখ্যানের তুলনায় পরিস্থিতি কিছুটা হলেও ভালো দেখাচ্ছে। সে সময় খেলাপি ঋণ ছিল ৬৭১ কোটি টাকা, যা ওই সময় বিতরণকৃত ঋণের ৭৮ দশমিক ৪০ শতাংশ।
আদায়ের অঙ্কটা খুব বেশি না হলেও দুই কোটি টাকা আদায় কিছুটা হলেও স্বস্তি নিয়ে আসতে পেরেছে।
ব্যাংক আল ফালাহ
বিদেশি এই ব্যাংকটির মার্চ শেষে ঋণ বিতরণ ৯৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৩৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ।
ব্যাংকটির অবস্থা ডিসেম্বর শেষেও ছিল খুবই ভালো অবস্থানে। সে সময় খেলাপি ঋণ ছিল ৩৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
তিন মাসে ব্যাংকটি ২২ লাখ টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে।