প্রথমে ৬৬টির পর ৩০টি। দুই ধাপে ৯৬টি কোম্পানির লেনদেনের চিত্র যাচাই-বাছাই করে পুঁজিবাজার থেকে শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বা ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করে নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
সংস্থাটির মুখপাত্র রেজাউল করিম বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ফ্লোর প্রত্যাহারের পাশাপাশি আগে ৯৬টি কোম্পানির দরপতনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ যে ২ শতাংশের সীমা ছিল, সেই সুবিধাও আর থাকছে না। এখন থেকে এক দিনে যেমন সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ দাম বাড়তে পারবে, তেমনি একই পরিমাণ কমতেও পারবে।
বিএসইসির মুখপাত্র বলেন, ‘দুই ধাপে পুঁজিবাজার থেকে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়ার পর দেখা গেছে, সেই কোম্পানিগুলোর লেনদেন কয়েক গুণ বেড়েছে। বরং ফ্লোর প্রাইসের কারণেই সেসব কোম্পানিতে তারল্য আটকে ছিল। এখন আর সে সমস্যা থাকবে না।’
বৃহস্পতিবার বিএসইসি এক নির্দেশনায় জানিয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের প্রান্তসীমা বা ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
কমিশনের চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বার্তায় বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
২০২০ সালে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর ১৯ মার্চ সব কটি শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়া হয়।
শুরুতে এই বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বস্তির বার্তা নিয়ে এলেও পরে এই ফ্লোর প্রাইস লেনদেনের একটি বাধা হিসেবে প্রমাণ হয়।
ফ্লোর প্রাইস ও সর্বোচ্চ কাম কমার মার্জিন ২ শতাংশের আদেশ প্রত্যাহার করে বিএসইসির নির্দেশনা
বিষয়টি স্পষ্ট হয় দুবার। গত ৭ এপ্রিল প্রথম দফায় ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রত্যাহারের পর কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতন হলেও সেগুলোর শেয়ার হাতবদল বেড়ে যায়। একপর্যায়ে অনেক কোম্পানির দাম বাতিল হওয়া ফ্লোর প্রাইসের ওপরে উঠে আসে।
দ্বিতীয় দফায় ৩ জুন বাকি ৩০টি কোম্পানির ফ্লোর প্রত্যাহারের পরেও একই চিত্র দেখা দেয়।
তখনও দেখা যায়, যেসব কোম্পানির লেনদেন হচ্ছিল না বললেই চলে, সেগুলোর লাখ লাখ শেয়ার হাতবদল হয়েছে। এমনকি একটি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে এক কোটির বেশি।
সিদ্ধান্ত অকস্মাৎ নয়
ফ্লোর প্রাইস যে উঠে যাচ্ছে, সেটি বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ মে মাসের মাঝামাঝি সময়েই নিউজবাংলাকে জানিয়েছিলেন।
করোনা সংক্রমণের পর ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি কাটিয়ে গত বছরের জুনে যখন পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হয়, সেখান থেকে পুঁজিবাজারে দেড় হাজার পয়েন্টের বেশি সূচক বাড়লেও বেশ কিছু কোম্পানির লেনদেন হচ্ছিল না বললেই চলে।
ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো কোম্পানির মৌলভিত্তি বিবেচনায় না নিয়ে বাজারমূল্যকেই বিবেচনা করা হয়। ২০২০ সালের ২২ মার্চের আগের পাঁচ দিনের গড় মূল্য ফ্লোর প্রাইস হিসেবে ধরা হয়।
কিন্তু সে সময় যে ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়েছিল, পরে শতাধিক কোম্পানির ক্ষেত্রে সে দাম আর যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি বিনিয়োগকারীদের কাছে। এ কারণে আর লেনদেন হয়নি।
তবে ৭ এপ্রিল ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রত্যাহারের পর আটকে যাওয়া প্রতিটি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হতে থাকে। এই অভিজ্ঞতা থেকে মে মাসেই বাকিগুলোর ফ্লোর ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়।
ফ্লোর প্রাইস যে থাকছে না, সেটি বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ গত ১৭ মে নিউজবাংলাকে জানিয়েছিলেন
গত ১৭ মে বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এক বছর আগে যে উদ্দেশ্যে পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস দেয়া হয়েছিল, সেটি খুবই কার্যকর হয়েছে। তখন ফ্লোর প্রাইস দেয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বেড়েছিল। এক বছর পর পুঁজিবাজারে যে অবস্থায় ফিরেছে, তাতে সেই আস্থার জায়গাটি অনেক শক্ত হয়েছে। ফলে এখন মনে হয়, ফ্লোর প্রাইসের আর প্রয়োজন নেই।’
তাহলে কবে প্রত্যাহার হচ্ছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথম পর্যায়ে ৬৬টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস বাতিল করেছি। তিনটি ক্যাটাগরিতে তা করা হয়েছিল। প্রথম ক্যাটাগরি হিসাবে যেসব কোম্পানির শেয়ার দর ৫০ টাকার নিচে, সেগুলোর বাতিল করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকিগুলোরও ফ্লোর প্রাইস বাতিল করা হবে।’
এরপর ২ জুন বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম জানান, ৩০ থেকে ৩২টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস দ্বিতীয় ধাপে তুলে নেয়া হচ্ছে। এগুলোর লেনদেনও আটকে আছে ফ্লোর প্রাইসে।
পরের দিনই সেগুলো প্রত্যাহার করার আদেশ জারি হয়।
‘দাম কমার সীমা ২ শতাংশ থাকলে ভালো ছিল’
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য গড়ে তোলা ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক গবেষণাপ্রধান দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এর আগে ৯৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রত্যাহারের পর বাজারে তারল্য বেড়েছে। এরপরেও বেশ কিছু কোম্পানি ছিল, যেগুলো ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হচ্ছিল না বললেই চলে। এখন থেকে এগুলোও বিক্রি হবে।’
প্রথম ধাপে ফ্লোর প্রত্যাহার করে নেয়া ৬৬ কোম্পানির তালিকা
তবে দরপতনের সর্বনিম্ন সীমা ২ শতাংশ আরও কিছুদিন রাখা দরকার ছিল বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ‘একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সুবিধা দেয়া হয়েছিল। এটি আরও কিছুদিন চালু থাকলে বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বস্তিদায়ক হতে পারত।’
দাম বৃদ্ধি ও কমতে সর্বোচ্চ কত শতাংশ
নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী আগের নিয়মেই তালিকাভুক্ত কোম্পানির সার্কিট ব্রেকার প্রযোজ্য হবে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শেয়ার দর ২০০ টাকা পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ার দর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়তে বা কমতে পারবে।
এ ছাড়া ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে থাকা শেয়ারের দর ৮.৭৫ শতাংশ, ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার শেয়ারের দর ৭.৭০ শতাংশ, ১০০০ থেকে ২০০০ টাকার শেয়ারের দর ৬.২৫ শতাংশ, ২০০০ থেকে ৫০০০ হাজার টাকার শেয়ারের দর ৫ শতাংশ এবং ৫০০০ টাকার ওপরে থাকা শেয়ার দর দিনে ৩.৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে বা কমতে পারবে।
ফ্লোর প্রাইসের কারণে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে সমস্যা
গত ৭ এপ্রিল প্রথম ধাপে ৬৬ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর বিএসইসি চেয়ারম্যান নিউজবাংলাকে জানান, এই বিষয়টির কারণে বাংলাদেশে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার আন্তর্জাতিক মান কমে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় ধাপে ফ্লোর প্রত্যাহার করা ৩০ কোম্পানির তালিকা
তিনি সে সময় ‘দীর্ঘ সময় ধরে ফ্লোর প্রাইস থাকায় আমাদের পুঁজিবাজার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পিছিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আমরা বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশন (আইওএসসিও) সদস্য। সেখানে আমাদের ক্যাটাগরি ‘এ’। দীর্ঘ সময় ধরে ফ্লোর প্রাইসের মাধ্যমে বাজার ম্যানিপুলেট করায় আমাদের ক্যাটাগরি পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’