চালু ও বন্ধ মিলিয়ে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ছয়টি দেশি এয়ারলাইনসের কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় নানা ফি বাবদ পাবে প্রায় ৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে মূল বকেয়া ৩০৬ কোটি ৭৫ লাখ ৬১ হাজার ৯৬৭ টাকা। আর মূল বকেয়ার ওপর সারচার্জ ৩ হাজার ৭০৫ কোটি ৭৪ লাখ ৭৭ হাজার ১৭৪ টাকা।
এয়ারলাইনসগুলো প্রতি এক টাকা বকেয়ার জন্য সারচার্জ গুনছে প্রায় ১২ টাকা করে।
নির্দিষ্ট সময়ে বকেয়া আদায়ে ব্যর্থ হলে এয়ারলাইসগুলোর বকেয়ার ওপর প্রতি ৩০ দিনে ৬ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারি করে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়।
কোনো এয়ারলাইনস এক বছর বকেয়া আদায় করতে না পারলে তাকে মূল বকেয়ার ওপর ৭২ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ দিতে হচ্ছে।
চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এক হিসাব অনুযায়ী, বেবিচকের কাছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমানের বকেয়া ৪ হাজার ৩১৫ কোটি ১১ লাখ ৩১ হাজার ৭১৫ টাকা। বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে নভো এয়ারের বকেয়া ৩ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার ১৭৯ টাকা। এর মধ্যে সারচার্জ ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৮০ টাকা এবং ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের কাছে বকেয়া ১৬ কোটি ৮২ লাখ ৭৭ হাজার ৬৮ টাকা, যার মধ্যে সারচার্জ ৯ লাখ ১৮ হাজার ১৬১ টাকা।
ফ্লাইটে না থাকা এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে রিজেন্ট এয়ারের কাছে বেবিচকের বকেয়া ২৮৩ কোটি ৩৮ লাখ ২৮ হাজার ১৭৩ টাকা, যার মধ্যে সারচার্জ ১১৯ কোটি ২৮ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬৮ টাকা। ইউনাইটেড এয়ারের কাছে বকেয়া ২০৩ কোটি ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯৩ টাকা, যার মধ্যে সারচার্জ ১৪৬ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার ২০২ টাকা।
জিএমজি এয়ারলাইনসের বকেয়া ৩৬৮ কোটি ২৯ লাখ ৬ হাজার ৪৮ টাকায় সারচার্জ এসেছে ৩১১ কোটি ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৫৭৯ টাকা।
বকেয়ার ওপর বছরে ৭২ শতাংশ হারে সারচার্জ পরিশোধ করতে গিয়ে তারা ফতুর হয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করে আসে এয়ারলাইনসগুলো। তারা বলছে, সারচার্জের ফাঁদে পড়ে ব্যবসা গোটাতে হয়েছে অনেক এয়ারলাইনসকে।
দেশি এয়ারলাইনসগুলোর সংগঠন অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের (এএওবি) সেক্রেটারি জেনারেল মফিজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এত বেশি সারচার্জ পৃথিবীর কোথাও আছে কি না আমার জানা নেই। বিভিন্ন কারণে বকেয়া হতে পারে। সেটা যদি ঘড়ির কাঁটার মতো প্রতি মাসে ৬ শতাংশ হারে বাড়তেই থাকে তাহলে বছর ঘুরতেই বকেয়া প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
‘এটা যদি বছরে ১০ থেকে ১২ শতাংশ হতো, তাও সহনীয় হতো। এখন যেটা আছে, সেটা খুবই অযৌক্তিক।’
এভিয়েশেন বিশেষজ্ঞরা সারচার্জের এই হারকে অযৌক্তিক দাবি করে একে এভিয়েশন খাতের জন্য বিপজ্জনক বলছেন।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এটিএম নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৩ সালে একটি গেজেট করা হয়েছিল। এটা কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছিল, সেটি স্পষ্ট নয়। এটি এভিয়েশন খাতের জন্য ছুরিকাঘাত। কেউ যদি নির্দিষ্ট সময়ে পাওনা আদায় না করতে পারে, তাহলে অবশ্যই সারচার্জ নিতে পারে। কিন্তু সেটা হতে হবে যৌক্তিক।
‘এখন যে সারচার্জ আরোপ করা আছে, সেটা কাবুলিওয়ালাদের সুদ নেয়ার মতো। আসল নয়, সুদ দাও। এখন নেয়া হচ্ছে প্রতি ৩০ দিনে ৬ শতাংশ, মানে যেটা দাঁড়াচ্ছে বছরে ৭২ শতাংশ। কম্পাউন্ড হিসেবে এটি আরও বেশি হবে। যে একবার এই ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে, সে কিন্তু আর বের হতে পারছে না।’
এই এভিয়েশন বিশেষজ্ঞের মতে, সারচার্জের কারণে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান খুব একটা সংকটে না পড়লেও বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোই বেশি সংকটে পড়ছে।
তিনি বলেন, ‘বিমানের সুবিধা হলো, বিমান যেহেতু রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান, সে যদি না দেয় দেখা যাবে সিভিল এভিয়েশন এটা নিয়ে হইচই করবে না। কিন্তু বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো কী করবে?
‘এর আগে যে এয়ারলাইন্সগুলো বসে গেছে, তার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু একটি বড় কারণ সারচার্জ। এত দেনা কীভাবে শোধ করবে?’
অবশ্য সারচার্জের কোনো দায় নিজেদের কাঁধে নিতে চায় না আকাশপথের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেবিচক। সংস্থাটির চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সারচার্জটা আসলে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। এটার ওপরে আমরা উল্টো ভ্যাট দিয়ে যাচ্ছি। আমাদেরই প্রতি বছর লস হচ্ছে।
‘মাফ করার জন্য আমাদের কিছু করার নেই। এটা দেশের ইকোনমিক পলিসি, এটা কী হারে হবে না হবে, কমবে না বাড়বে এটা অর্থ বিভাগ সিদ্ধান্ত নেবে।’
গত প্রায় দুই যুগে দেশে ১০টি বেসরকারি এয়ারলাইনস বিভিন্ন সময়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন টিকে আছে মাত্র দুটি। এ সময়ের মধ্যে একে একে পাখা গুটিয়েছে অ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবত, রয়্যাল বেঙ্গল, এয়ার বাংলাদেশ, জিএমজি এয়ারলাইন্স, বেস্ট এয়ার ও ইউনাইটেড এয়ার।
সবশেষ গত বছরের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে ফ্লাইট স্থগিত রেখেছে রিজেন্ট এয়ার। তাদের ফ্লাইটে ফেরা অনেকটাই অনিশ্চিত।
এখন ফ্লাইটে না থাকা এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে রিজেন্ট, জিএমজি ও ইউনাইটেড আন্তর্জাতিক রুটেও ফ্লাইট চালাত।