দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কম দামি নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেট পান করেন। অথচ, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই স্তরের সিগারেটরে দাম বাড়ানো হয়নি।
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে ধূমপানে নিরৎসাহিত করতে হলে কমদাম নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেটের শুল্ক-কর বাড়ানো খুবই জরুরি।
তা না হলে তামাকপণ্য আরও সহজলভ্য হবে এবং তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাকের ব্যবহার বাড়বে। যার ফলে হুমকির মুখে পড়বে জনস্বাস্থ্য।
তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ও অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স-আত্মা’র যৌথ উদ্যোগে আায়োজিত রোববার বাজেট-পরবর্তী আলোচনায় এসব দাবি জানিয়েছেন সংসদ সদস্য, অর্থনীতিবিদসহ দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ।
বাজেট সংশোধন করে সুনির্দিষ্ট কর আরোপের মাধ্যমে সিগারেটসহ সব তামাকপণ্যের দাম বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে প্রজ্ঞা বলেছে, নিম্ন ও মধ্যম স্তরসহ অন্যান্য তামাকজাত পণ্যে বর্ধিত করারোপ একটি দরিদ্র-বান্ধব উদ্যোগ।
এসব পণ্যের দাম বাড়লে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রবণতা অধিক হারে হ্রাস পাবে। এতে কমবে অকাল মৃত্যু। বাড়বে আরও রাজস্ব আয়।
প্রস্তাবিত অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ তুলে ধরে প্রজ্ঞার পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে বাজারের প্রায় ৭২ শতাংশ নিম্ন ও প্রায় ১৬ শতাংশ মধ্যম স্তরের সিগারেট।
অথচ, প্রস্তাবিত বাজেটে এই দুই স্তরের সিগারেটের দাম ও করহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
অপরদিকে, নতুন বাজেটে শুধু উচ্চ এবং প্রিমিয়াম স্তরে গড়ে মাত্র ৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি করা হয়।
নামমাত্র এই দাম বাড়িয়ে ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। বরং সরকার এই বাজটে মূল্যবৃদ্ধির যে প্রস্তাব করেছে, তা কার্যকর হলে বেশির ভাগ সিগারেট আরও সস্তা হবে।
পরিসংখ্যানে বলা হয়, ২০০৯ এর তুলনায় ২০১৭ সালে সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ধূমপান বিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেট পাস হলে সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা আরও বাড়বে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, গত এক বছরে করোনায় যত মানুষ মারা গেছে, তার চেয়ে ১০/১৫ গুণ মারা গেছে তামাকজনিত পণ্যের ব্যবহারের কারণে।
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাজেট সংশোধন করে নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেটকে একীভূত করে সুনির্দিষ্ট করারোপের দাবি জানান তিনি।
পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ও জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘আমরা সকল তামাকপণ্যের দাম বৃদ্ধির ও সুনির্দিষ্ট করারোপের কথা বলেছিলাম। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে সেটা করা হয়নি।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, কমদামি সিগারেটের দাম বাড়াতে হবে। এর ফলে তরুণরা ধূমপানে নিরুৎসাহিত হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এর রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, প্রায় ৮৮ শতাংশ মানুষ নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেটের ভোক্তা।
তাই, এই স্তরে দাম বাড়ানো জরুরি। এতে একদিকে, স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে। অন্যদিকে, বাড়বে রাজস্ব আদায়।
আলোচনায় আরও অংশ নেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমদ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার ডা. সৈয়দ মাহফুজুল হক, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে), বাংলাদেশ-এর লিড পলিসি অ্যাডভাইজার মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী।
বাজেট বিশ্লেষণ এবং প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রজ্ঞার তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার।
বাজেট সংশোধন করে কিছু প্রস্তাব অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছে প্রজ্ঞা। এর মধ্যে রয়েছে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য নিম্ন স্তরে ৫০ টাকা, মধ্যম স্তরে ৭০ টাকা, উচ্চ স্তরে ১১০ টাকা এবং প্রিমিয়াম স্তরে ১৪০ টাকা নির্ধারণ করে যথাক্রমে ৩২.৫০ টাকা, ৪৫.৫০ টাকা, ৭১.৫০ টাকা এবং ৯১ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
মধ্য মেয়াদে (২০২১-২২ থেকে ২০২৫-২৬) সিগারেটের ব্রান্ডগুলোর মধ্যে দাম ও করহারের ব্যবধান কমিয়ে মূল্য স্তরের সংখ্যা চারটি থেকে দুটিতে নামিয়ে আনা।
ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১.২৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।
প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা।