শুরুটা ছিল অবসাদগ্রস্ত দিনের একটি টুইট থেকে। টুইটে লেখা ছিল, ‘এই বিস্কুট সত্যিই আসক্তিকর।’
উজ্জ্বল লাল রঙের বিস্কুটের প্যাকেটের ওপর টানা অক্ষরে লেখা ছিল ‘প্রাণ পটাটা স্পাইসি বিস্কুট’।
তারপর দেখলাম এই প্যাকেটটি প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে। আমার টুইটার টাইম লাইনের সবাই এটি নিয়ে কথা বলছে। কীভাবে লকডাউনের সময় কেউ এটি খুঁজে পেয়েছে সেটি নিয়েও কথা হচ্ছে। ইনস্টাগ্রাম পোস্ট ও স্টোরিতেও একই অবস্থা। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপসহ সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরেও আলোচনা দেখলাম কীভাবে এই মেড ইন বাংলাদেশ বিস্কুটটি সহজে সংগ্রহ করা যাবে।
দেরি না করে আমাজনে অর্ডার করলাম। একজন জানাল, সে তার কাছের এক মুদি দোকানে এই বিস্কুট খুঁজে পেয়েছে। শিগগিরই কয়েক প্যাকেট পটাটা বিস্কুট ডেলিভারি সেবা ডুঞ্জোর মাধ্যমে বেঙ্গালুরুতে অনেকের কাছে পাঠানো হলো।
কয়েক ঘণ্টা পর একজন জানাল, ‘আমি এক শ্বাসে পুরো এক প্যাকেট খেয়ে ফেলি’।
আমার প্যাকেটটি পৌঁছাল পরের দিন। আমি এক প্যাকেট আলাদা করলাম। তবে ভয়ে ছিলাম, যদি হতাশ হই।
পাঠক, এখন বাস্তবে পরখ করে দেখার পালা। প্যাকেটের ভেতর চিকন সারিতে গোল ও সোনালি চাকতির মতো বিস্কুটগুলো ঠিকঠাক রাখা। এতে যথেষ্ট পরিমাণে আলুকে বিস্কুটে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এগুলো পাতলা, ছোট এবং মুড়মুড়ে। স্বাদের মিশ্রণ, প্রয়োজনীয় মিষ্টি-লবণ-টক-মসলার সমন্বয় এটিকে পরিণত করেছে শক্তিশালী স্বাদের বোমায়।
পটাটা নিয়ে মুম্বাইয়ের কনটেন্ট ক্রিয়েটর রাহুল যাদব বলেন, ‘এটি একেবারেই বহুমুখী স্বাদের। চিজ এবং মসলাদার আলুর তরকারি হিসেবেও এটিকে পরখ করেছি। এটি স্বাদে অনন্য।’
রাহুলের করা টুইটে অনেকে প্রথমবারের মতো পটাটার নাম শোনেন। তিনি বিস্কুটটি সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলেন ২০১৯ সালের দিকে ‘হাইওয়ে অন মাই প্লেট’ নামের শোর দুই হোস্ট রোকেয়া সিং ও ময়ূর শর্মার টুইট থেকে।
এটি অনেকটাই ধাঁধার মতো, কেন একটি প্যাকেজড ফুড মানুষের কাছে এত জনপ্রিয় হলো।
কেন ম্যাগি নুডলস ভারতের অন্য যেকোনো নুডলসের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়?
পালস ক্যান্ডি আসার অনেক আগে থেকেই লেমন ক্যান্ডি ছিল। তবুও এখন পালস যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, অন্য কোনো ক্যান্ডি সেটি স্বপ্নেই দেখে।
একই কথা কোকা-কোলা, আমুল বাটার বা হলদিরাম আলু ভুজিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হয়তো তারা মানুষের অতীত স্মৃতি-প্রত্যাশা-নতুনত্বের মধুর কোনো জায়গাকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। বাংলাদেশি কনজ্যুমার কোম্পানি প্রাণের এই বিস্কুট সেই জায়গাটি খুঁজে পেয়েছে।
লাইভমিন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় অনেক কোম্পানি থাকার পরও এক দশক আগে প্রাণের পণ্য এ অঞ্চলে যাত্রা শুরু করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল টোস্ট বিস্কুট, প্যাকেট ঝালমুড়ি, ইনস্ট্যান্ট নুডলস এবং প্যাকেট জুস।
সম্ভবত পটাটা তাদের প্রথম পণ্য যা পুরো ভারতে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এটি এখন পূর্বে জয়পুর থেকে দক্ষিণে বেঙ্গালুরু পর্যন্ত অধিকাংশ জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘প্রাণ এখন পুরো ভারতেই ছড়িয়ে পড়েছে। এই ব্র্যান্ডের মূল কোম্পানি কৃষি ও খামার যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে স্টেশনারি, খেলনাসহ প্রায় সব কিছু তৈরি এবং বিক্রি করছে।’
প্রাণ কি বাংলাদেশে রিলায়েন্স (ভারতের বহুজাতিক কোম্পানি)- এমন প্রশ্নে আহসান খান বলেন, ‘না না, ভারতের বড় কোম্পানির তুলনায় আমরা অনেক ছোট। যদিও এই কোম্পানি এখন পর্যন্ত এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান করেছে। ১৪৫ দেশে পণ্য রপ্তানি করছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি টাকা বা প্রায় ৯৩ কোটি ভারতীয় রুপি।
২০১৫ সালে কোম্পানিটি ভারতে তাদের প্রথম কারখানা চালু করে ত্রিপুরার আগরতলায়। আহসান খান বলেন, ‘ভারত আমাদের জন্য বড় বাজার। আমরা ভারতের ৭০০ জেলায় থাকতে চাই। আমরা করপোরেট ভারতকে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখি, কীভাবে আরও সংগঠিত হওয়া যায়, কীভাবে আরও প্রফেশনালি কোম্পানি চালানো যায়।
‘মাত্রই আমি ঝাড়খন্ডের এক ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে কথা বলেছি, এর কিছু আগে আফ্রিকায় একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার স্বপ্ন একটি গ্লোবাল কোম্পানি হওয়া। বর্ডারস আর মিনিংলেস।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক দশক পর ১৯৮১ সালে প্রাণ ফুডসের মূল কোম্পানি প্রাণ-আরএফএল শুরু করেছিলেন আহসান খানের বাবা আমজাদ খান চৌধুরী।
আহসান খান বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল আমজাদ খান চৌধুরীর ছিল কঠিন দেশপ্রেম। তিনি চেয়েছিলেন নবীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হোক, দারিদ্র্যমুক্ত হোক। কৃষি-ব্যবসার মাধ্যমে কৃষকদের শক্তিশালী করা ছিল তার লক্ষ্য।
আহসান খান আমেরিকার আইওয়া রাজ্যের ওয়ার্টবুর্গ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ২১ বছর বয়সে প্রাণে যোগ দেন। তিনি কোম্পানিকে আরও বেশি ভোক্তার কাছে নিয়ে যাওয়া এবং নতুনত্ব আনতে কাজ করছেন। নতুন কিছু বের করতে এবং কারখানায় তা উৎপাদনে বেশ দক্ষ আহসান খান।
তিনি বলেন, ‘যখন আমি দক্ষিণ ভারতে সফরে যাই, দেখি এমটিআরের (ভারতের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের প্রতিষ্ঠান) মতো কোম্পানি খাবার উপযোগী উপমা-ইডলি মিক্স বিক্রি করছে। ইন্ডিগোতে ভ্রমণের সময় দেখি তাদের উপমা ও ডাল-চাল বক্সে গরম পানির সঙ্গে মেশালে খাবার তৈরি হয়ে যায়। আমি ভাবি কীভাবে এমন খাবার আমরা তৈরি করতে পারি।’
চীন ভ্রমণের সময় তাদের আলুর ওয়েফারের মতো বিস্কুট দেখে পটাটা তৈরির উৎসাহ পান আহসান খান। দেশে আসার পর তিনি খাদ্য প্রকৌশলীদের ডেকে পটেটো প্লেক্স, পটেটো পেস্ট এবং স্টার্চের সঙ্গে অন্যান্য স্বাদের মিশ্রণে পটেটো চিপসের মতো নতুন কিছু তৈরি করতে বলেন, যা খেতে মুড়মুড়ে হলেও পাতলা হবে।
আহসান খান জানতেন, তিনি ব্রিটানিয়া ও আইটিসি বিস্কুটের দাপট থাকা ভারতের বড় বাজারে ঢুকতে যাচ্ছেন। তবে সাহস হারাননি প্রাণের এই কর্ণধার।
আহসান খান বলেন, ‘তারা অনেক বড়, তাদের কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখার আছে। এমনকি ভারতের অন্য বড় কোম্পানি থেকেও শেখার আছে। ভারত অনেক বড় বাজার। আমি পটাটা বিস্কুটকে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে চাই।’