বিকল্প পণ্য উৎপাদন করে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে কুষ্টিয়া সুগার মিল। ১২ জুন শিল্প মন্ত্রণালয়ের চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বৈঠকের জন্য তেমন প্রস্তাবই দেয়া হয়েছে।
লোকসানের ভারে গত ডিসেম্বরে মাড়াই বন্ধ করে দেয়া হয় যে ছয়টি চিনিকলে, তার একটি কুষ্টিয়ার এই মিল। সামনের মৌসুমেও এখানে মাড়াই বন্ধ থাকবে। মিল এলাকায় যে সামান্য আখ চাষ হয়েছে, তা দিয়ে মৌসুম চালানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন মিলের কর্মকর্তারা।
৬০ বছরের পুরোনো এই শিল্প একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত এলাকার মানুষ।
মিলের সেন্টার ইনচার্জ (সিআইসি) আবুল কালাম আজাদ জানান, গত মৌসুম থেকে মাড়াই বন্ধ রয়েছে। এ জন্য আখচাষিদের ঋণ, সার, কীটনাশক, বীজ কোনো কিছুই দেয়া হয়নি। এতে অনেকেই আখ লাগাননি। যাদের আখ ছিল তাদের অনেকেই বিক্রির পর মুড়ি আখও ভেঙে ফেলেছেন।
তিনি আরও জানান, তাদের এখন পর্যন্ত করা সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, মিল এলাকায় ১ হাজার ৬০০ একরে আখ চাষ হয়েছে। অথচ মিলটি চালাতে ১০ হাজার একরের আখ দরকার হয়।
সরকার চাইলে এসব আখ পার্শ্ববর্তী মিলে সরবরাহ করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
প্রায় ৬০০ কোটি টাকা লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে এখনও অবশ্য স্বপ্ন দেখছেন শ্রমিকনেতারা। তারা বলছেন, চাল, পানি ও অ্যালকোহলের মতো বিকল্প পণ্য দিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।
কুষ্টিয়া চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক তারিক হাসান সাগর বলেন, ‘সুগার মিল চলে তিন মাস। বাকি সময় এই বিশাল জায়গা পড়েই থাকে। এখানে কয়েকটি অটো রাইস মিল বসিয়ে দেয়া গেলে লাভের মুখ দেখা সম্ভব।’
ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন বলেন, ‘সাত কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে পানির ফিল্টার বসানো হচ্ছে। এখানকার পরিশোধিত পানি সারা দেশে সরবরাহ করলে ব্যাপক লাভ করা সম্ভব।
‘আর চিটাগুড় দিয়ে মদ তৈরি করা যায়। এসব বাই প্রোডাক্ট দিয়ে দুই থেকে চার বছরের মধ্যেই আগের লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’
আগামীকাল শনিবার ১৬টি মিলের এমডি, মন্ত্রী এবং করপোরেশনের মধ্যে বৈঠক হবে। সেখানে এসব প্রস্তাব দেয়া হবে বলে জানান এই শ্রমিক নেতা।
চিনিকলগুলো চালু করা হলে অস্থিতিশীল চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে দাবি এই খাতের শ্রমিকরা। তারা জানান, এরই মধ্যে চিনির বাজার চড়া হয়ে গেছে। তাই মিলগুলো গুটিয়ে না ফেলে আধুনিকায়ন করা উচিত।
সুগার মিলের এমডি রাকিবুর রহমান খান বলেন, ‘মন্ত্রণালয় ও করপোরেশনের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে এই মিলের ভাগ্য।’
কুষ্টিয়া শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে জগতি এলাকায় ১৯৬১ সালে এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৬৫-৬৬ মৌসুম থেকে এটি চিনি উৎপাদন শুরু করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে।
শুরুতে লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি ২০০১ সাল থেকে লোকসানের মুখে পড়ে। এরপর প্রতিবছরই লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এরপর ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে কুষ্টিয়া চিনিকলসহ ৬টি মিলের আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।
এর আগে থেকেই অবশ্য আন্দোলনে ছিলেন এখানকার শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষিরা।
এদিকে গুদাম থেকে ৫২ দশমিক ৭ টন চিনি গায়েব হয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনায় এসেছে কুষ্টিয়া চিনিকল। এ ঘটনায় ঢাকা থেকে আসা শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল কাজ করেছে।
মিলের শ্রমিকনেতারা জানান, কয়েক বছর আগে থেকেই অল্প অল্প করে চিনি সরানো হয়। গত মৌসুমে মাড়াই না থাকায় চিনির মজুত ১০০ টনের কাছাকাছি চলে আসায় চোখের আন্দাজে চিনি কম থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে। বর্তমানে কারখানায় ৭০ টনের মতো চিনি মজুত আছে। বাকি ৫২ দশমিক ৭ টন চিনির কোনো হদিস নেই।
শ্রমিক-কর্মচারীরা বলছেন, প্রতিনিয়তই এ ধরনের চুরি হয়ে থাকে। কিন্তু গুদামে প্রচুর চিনি থাকায় অসংগতি চোখে পড়ে না।
৩ জুন বিষয়টি টের পাওয়ার পর স্টোরকিপার ফরিদুল হককে বরখাস্ত করা হয়েছে। চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (কারখানা) কল্যাণ কুমার দেবনাথকে প্রধান করে তিন সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটিও কাজ করছে।