চীন বিশ্বের অন্যতম আমদানিকারক হলেও দেশটির বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারের আশেপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এই গন্ডি থেকে বের হয়ে দেশটিতে রপ্তানি ১ শতাংশ বাড়াতে পারলে বাংলাদেশ আরও ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা।
চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগও দেশে টানার আহ্বান তাদের। বিনিয়োগের মাত্র ১ শতাংশও টানা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে চীনের অতিরিক্ত বিনিয়োগ ২৫ বিলিয়ন ডলারে বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বুধবার ‘বাংলাদেশ-চায়না ইকনোমিক অ্যান্ড ট্রেড রিলেশনস ইন দ্যা আফটারম্যাথ অফ কোভিড-১৯ গ্লোবাল প্যানডেমিক’ শীর্ষক ভার্চুয়াল ওয়েবিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য জানানো হয়। ইকোনমিক রিপোর্টাার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রি (বিসিসিসিআই) যৌথভাবে এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত এইচ ই লি জিমিং, বেইজিংয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামান, বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি গাজী গোলাম মোর্তূজাসহ আরও অনেকে।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সার্বিক প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে মূল প্রবন্ধে আব্দুর রাজ্জাক জানান, এই মুহূর্তে চীন বিশ্বের সেরা রপ্তানিকারক দেশ। তবে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও অনেক বেশি। স্থানীয় শিল্পের প্রয়োজনের চাহিদা মেটাতে তারা রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার পাশাপাশি সেরা আমদানিকারক। কিন্তু বাংলাদেশ চীনের বাজারে এই ক্রয় চাহিদার সুযোগ সেভাবে নিতে পারছে না। অথচ চীন হচ্ছে বিশ্বের সেরা আমদানিকারক।
তিনি বলেন, দেশটির ক্রয় চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ যদি মাত্র ১ শতাংশ রপ্তানি এই বাজারে বাড়াতে পারে তাহলে বর্তমানের তুলনায় দেশের রপ্তানি আয় অতিরিক্ত যোগ হবে ৫ বিলিয়ন ডলার। একইভাবে চীনের বিনিয়োগও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেই বিনিয়োগের মাত্র ১ শতাংশ যদি আনা যায় তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে চীনের অতিরিক্ত বিনিয়োগ বাড়বে ২৫ বিলিয়ন ডলার।’
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন বহু দিন ধরেই চালকের আসনে রয়েছে। আগামীতে তাদের অবস্থান আরও সুসংহত হবে। তাই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লে এর থেকে বাংলাদেশই বেশি লাভবান হবে। তবে এর জন্য বাংলাদেশকেই তৎপর হওয়া জরুরি।
মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, বৈশ্বিক করোনার কারণে অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুচকগুলো নরবড়ে হয়ে পড়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নেমে আসাই এর অন্যতম প্রমাণ।
দেশের অর্থনীতির এই ক্ষয়িষ্ণু পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অর্থনীতিবিদ আব্দুর রাজ্জাক সবার আগে জনগোষ্ঠীকে ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রমে জোর প্রয়োগ, রপ্তানি বৃদ্ধি ও পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) টানায় গুরুত্বারোপ করেন। সেই সঙ্গে এই উত্তরণ প্রক্রিয়া সহায়ক শক্তি হিসেবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও বাড়ানোরও তাগিদ দেন।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, করোনা সংক্রমণ থেকে অর্থনৈতিক পুণরুদ্ধার প্রক্রিয়ার দৌড়ে বিশ্বে সবার আগে চীনই বেশি সাফল্য পেয়েছে। তা ছাড়া, চীনের অর্থনীতিতে যন্ত্র প্রকৌশল, তথ্য প্রযুক্তি, নবায়ণযোগ্য এনার্জি, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ সহ অর্থনীতি অগ্রগতি সহায়ক বহুমাত্রিক সংযোগ রয়েছে। এটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চীনের সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তিকে আরও কার্যকর করার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরেরও পরামর্শ দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘চীন বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুপ্রতীম দেশ। তারা আমাদের বৃহত্তর বাণিজ্যিক অংশীদারও। চীন সরকার বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও চীনের বাজারে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি। এই ঘাটতি কমিয়ে আনতে কীভাবে আরও বাণিজ্য সহায়ক উদ্যোগ নেয়া যায় তা নিয়ে কাজ করছে সরকার। চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে সম্ভাব্যতাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের দেয়া সুযোগ বাংলাদেশই বেশি নিয়েছে। মূলত সুযোগগুলো কাজে লাগিয়েই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে উন্নিত চূড়ান্তে ধাপে উঠতে পেরেছে। একইভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্যেও বাংলাদেশের একটা সুসংহত অবস্থান তৈরি হয়েছে। সরকার অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব বাণিজ্যে ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা বাড়াতে করণীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে।
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামান বলেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিবেচনায় বেশ ভাল সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই সম্পর্কের উন্নয়নের আরও বিরাট সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লে দুই দেশই লাভবান হবে। তবে চীন বড় অর্থনীতি হওয়ার কারণে এই লাভ বাংলাদেশেরই বেশি হবে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এখন রপ্তানি বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ উন্নয়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারে নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে এই অবস্থান আরও সুসংহত করা যায়।’
বিডা চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, চীন বাংলাদেশে পাওয়ার, আইটি, ট্যানেল, পদ্মা সেতু সহ বিভিন্ন খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। এই বিনিয়োগ আরও বাড়াতে দুই পক্ষই চেষ্টা করছে।