বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অর্থ পাচারের তালিকা সরকারের হাতেই আছে

  •    
  • ৮ জুন, ২০২১ ২২:২৬

অর্থমন্ত্রী অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার হাতে অর্থ পাচারকারীদের বেশ কয়েকটি তালিকা আছে। কোনো তালিকা ধরেই কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদাহরণ নেই।

জাতীয় সংসদে সোমবার বক্তৃতাকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থ পাচার বন্ধে একপ্রকার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দেশের মানুষের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে চলে গেলে অন্যদের মতো তারও বেদনার অনুভূতি হয়।

মন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে যারা অর্থ পাচারে জড়িত, তাদের নামের তালিকা আহ্বান করেন বিরোধী দলের সাংসদদের কাছে।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে টাকা যায়। কীভাবে যায় এটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু কারা নেয় এটা জানি না। কারা টাকা নিয়ে যায়, লিস্ট আমার কাছে নেই। নামগুলো আমাদের দেন। কাজটি করা আমাদের জন্য সহজ হবে।’

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অর্থ পাচারকারীদের একাধিক তালিকা এই মুহূর্তে সরকারের হাতেই আছে। অর্থমন্ত্রীর নিজের মন্ত্রণালয়ের অধীন একাধিক সংস্থাসহ সরকারের কয়েকটি সংস্থা ও মন্ত্রণালয় এসব তালিকা তৈরি ও সংগ্রহ করেছে।

কয়েক মাস আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে কানাডায় অর্থ পাচারকারী ২৮ জনের একটি তালিকা ওই দেশের সরকারের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন বলেও জানিয়েছিলেন। কানাডার প্রবাসী বাংলাদেশিরাও দীর্ঘদিন ধরে সে দেশে টাকা পাচারকারী বাংলাদেশিদের প্রতিরোধে আন্দোলন করে যাচ্ছেন।

অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে তদন্ত করার দায়িত্বে সরকারের যেসব সংস্থা আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টিগ্রেশন সেল (সিআইসি) এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সোমবার জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় বিরোধী দলীয় সাংসদদের কাছে অর্থ পাচারকারীদের তালিকা চান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে নাম প্রকাশের শর্তে বলেন, অর্থ পাচারকারীদের তালিকা করার জন্য এনবিআর, বাংলাদেশ পুলিশের ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও দুদক মিলে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি একটি তালিকা তৈরি করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জমা দেয়। এটি প্রকাশ বা এর বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব সরকারের।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্ট্রিগ্রিটি (জিএফআই) তাদের ২০১৯ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানায়, কেবল ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যার বড় অংশই পাচার হয়েছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। অর্থাৎ আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। যেহেতু দেশের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাই এই দুই শ্রেণির মানুষই অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয় ওই রিপোর্টে। কিন্তু এতে কারো নাম প্রকাশ করা হয়নি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে তালিকা

২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউতে) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে কেবল কানাডায় অর্থ পাচারকারীদের সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’

বিদেশে অর্থপাচারে সরকারি আমলারা বেশি জড়িত বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী

মন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চারজন। এ ছাড়া কিছু আছেন আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। তবে পাচারে শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা। তবে তথ্য পাওয়া খুব কঠিন। বিভিন্ন মিডিয়ায় যে তথ্য বের হয়, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, আসলে সংখ্যাটি তত নয়।’

পাচারের দায় বিদেশি সরকারও এড়াতে পারে না উল্লেখ করে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘যেমন সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে কে টাকা রাখলেন, সেই তথ্য তারা আমাদের দেয় না। তারা ট্রান্সপারেন্সির কথা বলে, কিন্তু যদি বলি, কার কার টাকা আছে সেই তথ্য দাও, তখন তারা দেয় না। এটি একটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।’

বিএফআইইউ যা বলছে

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, গত পাঁচ বছরে তারা বিদেশে অর্থ পাচারের ১ হাজার ২৪টি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে। এর অর্ধেকের বেশি অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে কেবল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে।

এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চিঠি পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। বিএফআইইউর প্রতিবেদন মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১৬টি অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে।

এর বাইরে গত পাঁচ অর্থবছরে ২ হাজার ২৯০টি অর্থ পাচারের ঘটনার তথ্য সরবরাহ করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।

এ বিষয়ে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থ পাচারের অনেকগুলো মামলার বিচারকাজ চলছে। বিচারকাজ শেষ না হলে কেউ শাস্তির আওতায় আসবে না।’

তিনি বলেন, ‘অর্থ পাচারের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, বাংলাদেশ পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।’

প্রতিবেদনে পাচারকারীদের দেশের বাইরে কোথায় কী পরিমাণ সম্পদ, বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট ও বিনিয়োগ আছে তার বিবরণ দেয়া হয়েছে।

দেশে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি ও মানি একচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি মাসে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে দিয়ে থাকে।

কানাডার বেগমপাড়া

কানাডার প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় ‘বেগমপাড়া’। এটি মূলত দেশের ধনী ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের স্ত্রী-সন্তান যারা বিনিয়োগ ভিসায় কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন, তাদের এলাকা।

স্ত্রীরা সেখানে থাকেন আর স্বামীরা দেশ থেকে অর্থের জোগান দেন। এসব এলাকায় স্বামীরা স্থায়ীভাবে থাকেন না, তারা শুধু অর্থের জোগান দেন, আর মাঝে মাঝে বেড়াতে যান। এসব এলাকায় যারা বাড়ি করেছেন, তাদের বেশির ভাগই অর্থ পাচার করেছেন বলে জানা গেছে।

হঠাৎ করে আলোচনায় বেগমপাড়া আসার আরেকটি কারণ হলো কানাডার সরকারি সংস্থা দ্য ফিন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন অ্যান্ড রিপোর্ট অ্যানালাইসিস সেন্টার ফর কানাডা (ফিনট্র্যাক) গত এক বছরে (২০২০) সে দেশে ১ হাজার ৫৮২টি অর্থ পাচারের ঘটনা চিহ্নিত করে। তবে এ তালিকায় বাংলাদেশি কেউ আছে কি না, সে বিষয়ে এখনও কানাডা সরকার কিছু জানায়নি।

বেগমপাড়ায় অর্থ পাচারের বিষয়ে ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ, এনবিআর, দুদক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিরা।

বৈঠক শেষে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেন, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কানাডার বেগমপাড়ায় অর্থ পাচারের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করছে। এছাড়া সরকারি ৮০ জন কর্মকর্তার দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করছে দুদক।

বৈঠকে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিনউদ্দিন জানান, অর্থ পাচারের ঘটনায় তদন্তের দায়িত্বে থাকা সব সংস্থা তাদের প্রতিবেদন প্রস্তুত করছে।

তালিকা আছে, সদিচ্ছা নাই

দুদকের তালিকার বর্তমান অবস্থা নিয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থ পাচারকারীদের তালিকা উচ্চ আদালত আমাদের কাছে চেয়েছিল। আমরা আমাদের কাছে থাকা তালিকা আদালতে উপস্থাপন করেছি। আদালত যদি আবারও আমাদের কাছে এই তালিকার আপডেট চায়, আমরা তা আদালতকে সরবরাহ করব।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীর তালিকা চাওয়ার বিষয়টি হাস্যকর। এটা হলো দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এর মানে হলো, সরকার অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, নিতে চায় না।’

তিনি বলেন, ‘তালিকা থাকলে তো সরকারের কাছেই থাকবে। সরকারি সংস্থাগুলো সেই তালিকা তৈরিও করেছে। না করে করে থাকলে যে যে দেশে অর্থ পাচার হয়ে যায়, সেই দেশগুলোতে সরকার লোক পাঠাবে। তথ্য জোগাড় করে ব্যবস্থা নেবে। এই আইন ও উদাহরণ তো দেশে আছে। তাহলে এখন হচ্ছে না কেন! এটা হলো সরকারের সদিচ্ছার বিষয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই তো ২৮টি কেস স্টাডির প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছেন। সেই ২৮ জনের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?’

এ বিভাগের আরো খবর