করোনা মহামারিতে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রতি নজর দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে একটি ভার্চুয়াল আলোচনায়।
বলা হয়েছে, এই ‘ছোটরাই’ দেশকে সংকট থেকে রক্ষা করেছেন। তাই তাদেরকেই বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
রোববার ইমপ্যাক্ট অব কোভডি-১৯ অন সিএমএসএমইস অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং দেয়ার রিকোভারি: অ্যাভিডেন্স ফরম বিএসসিইসি ইন্ডাস্ট্রয়িাল অ্যাস্টেটস’ র্শীষক এক ভার্চুয়াল সেমিনারে যোগ দিয়ে প্যানেলে মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক আতিউর রহমান।
ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রিজম প্রকল্পের টেকনিক্যাল অ্যাসিসটেন্স কম্পোনেন্ট যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে।
দেশে ছোট উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখার তাগিদ দিয়ে আতিউর রহমান বলেন, ‘এই ছোটরাই এক সময় সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠবে। এর জন্য বড় শিল্পের সঙ্গে ছোট ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে এক সংযোগ-সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। এটা করা গেলে বড়-ছোট উভয়েই লাভবান হবে। যা দেশে টেকসই শিল্পায়ন নিশ্চিত করবে।’
‘ছোটদের’ উৎপাদিত পণ্য সরকারি কেনাকাটায় গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য আবারও প্রণোদনা দরকার হবে। চলমান প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার আগেই তা ঘোষণার প্রয়োজন হবে।’
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন প্রিজম টেকনিক্যাল অ্যাসিসটেন্ট প্রকল্পের সিনিয়র এক্সপার্ট ও বিআইডিএস এর গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।
আলোচনায় সারাদেশে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) সবকটি শিল্পাঞ্চলকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) আদলে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন আতিউর।
সাবেক এই গভর্নর বলেন, সারাদেশে ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা বিসিক শিল্পাঞ্চলও হয়ে ওঠতে পারে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (বেজা) মতো। এক্ষেত্রে বেজা যে রকম সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে, একইরকম সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে বিসিক অঞ্চলগুলোকেও অনুরূপভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়কেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
আতিউর রহমান বলেন, ‘পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং ব্যবসায়িক ধরন পরিবর্তন করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। একই সঙ্গে যুগের সন্ধিক্ষণ হিসেবে ব্যাংকিং কিংবা মার্কেট স্ট্যাট্যাজির স্রোতের সঙ্গেই উদ্যোক্তাদের এগোতে হবে। তবে এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতিও আরও সহজ করা জরুরি।’
ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ও হেড অব ডেলিগেশন রেনজি তেরিঙ্ক, বিসিকের চেয়ারম্যান মোশতাক হাসান এনডিসি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) গোলাম ইয়াহিয়া। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রিজম প্রকল্পের টেকনিক্যল অ্যাসিসটেন্স কম্পোনেন্ট এর টিম লিডর আলী সাবেত।
প্যানেল আলোচক হিসেবে অন্যদের মধ্যে অংশ নেন বিল্ড এর চেয়ারপারসন আবুল কাশেম খান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি রিজওয়ান রহমান এবং প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী। পুরো অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন ইআরএফ এর সাধারণ সম্পাদক এসএম রাশেদুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে রেনজি তেরিঙ্ক বলেন, করোনার আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ প্রশংসার যোগ্য। তবে করোনা মহামারিতে যারা কর্ম হারিয়েছে, তাদের দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সিএমএসএমইখাতের ওপর আরও নজর বাড়াতে হবে। ভবিষ্যতেও ইইউ বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘সরকারের প্রণোদনা বিতরণে নজর থাকতে হবে ছোটদের কেন্দ্র করেই। কারণ এই ছোটরাই পারে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে সব রকম সাপোর্ট দিতে।’
তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে উদ্যোক্তার আয়কে ছোট উদ্যোগ দাবি করে বাজেটে এ খাতের ওপর ট্যাক্স আরোপ মোটেও ভালো হয়নি বলে উল্রেখ করেন।
দেশে আবারও বিসিকের জোয়ার আসা দরকার উল্লেখ করে প্রাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘ছোট উদ্যোক্তারাই এক সময় বড় হয়। তাই সরকারকে ছোটদের প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে হবে। সহযোগিতা পেলেই ছোটরা বিকশিত হবে।’
বিল্ডের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান বলেন, ‘জরিপ বলছে, প্রণোদনা, ব্যাংক ঋণ ও বিসিকের সাহায্য ছাড়াই ৮৬ শতাংশ ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান তার ক্ষত পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে। তাদের এই চেষ্টার সঙ্গে সরকারের সহযোগিতা থাকলে ছোটরা অনেক দূর এগোতে পারবে।
‘তবে এর জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণে নিয়োজিত বিভিন্নস্তরের প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষকে আরও তৎপর হওয়া জরুরি। স্বচ্ছতা ও সক্ষমতাও দরকার।’
যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করারও দাবি জানান তিনি। বলেন, ‘নানা কারণে কিছু উদ্যোক্তা ঋণ পরিশোধ ব্যর্থ হতেই পারেন। তাই বলে তাদের যেন কোনো অবস্থাতেই খেলাপি করা না হয়। এটা করা হলে অনেক উদ্যোক্তার সম্ভাবনা ঝরে যাবে।’
বিসিক চেয়ারম্যান মো. মোস্তাক হাসান এনডিসি বলেন, ‘করোনা মহামারির মধ্যেও বিসিক শিল্প নগরীগুলো চালু ছিল। এগুলো চালু না থাকলে দেশ একটা বড় সংকটে পড়ে যেত।
‘তবে এটা ঠিক সিএমএসএমই সেক্টর একটা বড় ক্ষতি হয়েছে। তবে এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের যথেষ্ট উদ্যোগ ছিল। এ খাতে প্রণোদনার ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে ইতিমধ্যে ঋণ বিতরণ হয়ে গেছে।’
আলোচকদের এসব বক্তব্য ও পরামর্শের জবাবে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, ‘অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও টেকসই উন্নয়নের জন্য কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্প খাতকে সম্প্রসারিত করার বিকল্প নেই। কারণ, বাংলাদেশে সিএমএসএমই শিল্পখাতকেই জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এখাত কর্মসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, নারীর আর্থিক ক্ষমতায়ন ও রপ্তানি আয় বাড়াতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।’
তাই দেশে শিল্পখাতের উন্নয়নে বিশেষ করে ছোট উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিয়ে শিল্প বিপ্লব ঘটাতে রকারের যেখানে যে ধরনের পদক্ষেপ দরকার তারে সব কিছুই করছে সরকার।
মূল প্রবন্ধে ড. মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘করোর প্রকোপে উৎপাদন ও আয় কমে যাওয়ায় ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের (এসএমই) ৪৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে। পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। আংশিক কার্যক্রম চালু রেখেছে ৫১ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং ৪৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি কার্যক্রম চালিয়েছে।’
চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২১৬টি প্রতিষ্ঠানের জরিপ চালিয়ে তিনি এ তথ্য পেয়েছেন। তবে চলতি বছর ডিসেম্বর নাগাদ ক্ষতি কাটিয়ে এদের ৮০ শতাংশই উৎপাদনে ফিরতে পেরেছেন।