বাজেটে রাখা অগ্রিম আয়করের প্রস্তাবকে বেআইনি বলেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)।
এ বিষয়টি বাদ দিলে সংগঠনের মূল্যায়নে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটটি সব দিক বিবেচনায় কল্যাণমুখী।
কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী বাজেটে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আরও সুদৃঢ় করতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ রয়েছে।
এর জন্য সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করে ব্যবসায়ীদের সংগঠনটি।
শনিবার বাজেটের ওপর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘অগ্রিম আয়কর ব্যবসার খরচ বাড়ায়। এই কর নিয়ে সরকারের রাজস্ব আদায় তো বাড়েই না, উল্টো এটি ব্যবসায়ীদের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
‘বছর শেষে এই কর লাভালাভ হিসাব করে সরকারকে আবার ফেরতই দিতে হয়। কিন্তু এই কর দিয়ে কোনও ব্যবসায়ী নিশ্চিত নন যে, তারা বছর শেষে ব্যবসা থেকে লাভবান হবেন কি না।’
তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের এই খরচ কমাতে এফবিসিসিআই বিদ্যমান ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই প্রস্তাব আমলে না নিয়ে উল্টো বাজেটে ২০ শতাংশ পর্যন্ত সর্বোচ্চ অগ্রিম আয়কর আরোপ করেছে।
‘বাজেটে রাখা এ উদ্যোগ সম্পূর্ণ বেআইনি। এর ফলে আগামীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
‘এফবিসিসিআই বেআইনি এই অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারসহ সব রকম উৎসে কর চূড়ান্ত কর হিসেবে সমন্বয় করার প্রস্তাব করছে।’
বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করা যেকোনো পণ্যের ওপর অন্যান্য শুল্ককরের পাশাপাশি অতিরিক্ত হিসাবে সরকারকে ৫ শতাংশ হারে আগাম কর বা অগ্রিম আয়কর (অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স- এআইটি) দিতে হয়। অর্থমন্ত্রী এই অগ্রিম আয় কর চার গুণ বাড়িয়ে আগামী অর্থবছর থেকে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে।
বাজেটোত্তর এই সংবাদ সম্মেলনে মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবির, ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমানসহ এফবিসিসিআইয়ের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, ‘অর্থনৈতিক পরিকাঠামো অনুযায়ী বাজেটের আকারও বড় হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের বাজেট বাস্তবায়নের চিরায়ত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুশাসন, যথাযথ মনিটরিং, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায়।’
তাই বাজেট বাস্তবায়নে সব ক্ষেত্রে প্রশাসনিক এবং নির্বাহী দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং তদারকির মান ক্রমাগতভাবে উন্নয়ন ঘটানো জরুরি বলে মনে করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান প্রক্রিয়াকে গতিশীল করবে বলে মনে করেন তিনি।
তবে এসব অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব বা পিপিপি আরও ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। বলেন, ‘তাই পিপিপির ওপর বিশেষ নজর দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল
বাজেটে রাখা ঘাটতি মেটাতে যথাসম্ভব স্থানীয় ব্যাংকব্যবস্থার পরিবর্তে স্বল্প সুদে বিশেষ স্থানীয় বন্ড এবং বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের প্রচেষ্টা নেয়ার পরামর্শও রাখেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি।
বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এসব উদ্যোগের সঙ্গে খাতভিত্তিক বাণিজ্য সংগঠনগুলোর বিরাজমান সমস্যাগুলো নিরসন করা জরুরি। অন্যথায় ব্যবসা-বাণিজ্য নীতিমালার ক্ষেত্রে খাতওয়ারি অসংগতি থেকে যাবে। এসব বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের আমদানি শুল্ক, মূসক ও আয়করসংক্রান্ত বিশেষ কয়েকটি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে বিরাজমান খাতওয়ারি অসংগতি দূর হবে।’
এ সময় জসিম উদ্দিন বাজেট চূড়ান্তের আগে পুনর্বিবেচনার জন্য আট দফা সুপারিশ করেন।
তিনি বলেন, ‘সর্বমোট প্রাপ্তি ৩ কোটি টাকা বা ততোধিক হলে ব্যক্তি আয়করদাতাদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম করের হার ০.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এটি সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিবেচনার প্রস্তাব করছি।’
সফটওয়্যার অথবা আইটি সেবা বিক্রির মাধ্যমে আয়ের ওপর যে কর অব্যাহতি ছিল, তা প্রত্যাহার করারও বিরোধিতা করেন এফবিসিসিআইয়ের প্রধান। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশের লক্ষ্যে এই সুবিধা পুনর্বহাল করার প্রস্তাব করেন তিনি। কমপ্লায়েন্স সৃষ্টি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আগামী এক বছরের জন্য ই-কমার্সকে উৎসে করের আওতামুক্ত রাখার প্রস্তাবও করেন তিনি।
বাজেট পেশ করতে প্রধানমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সংসদে ঢুকছেন অর্থমন্ত্রী
এফবিসিসিআইয়ের অন্য সুপারিশগুলো মধ্যে রয়েছে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি এবং নৌপরিবহন সহজলভ্য করতে এবং সরকারের ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে ড্রেজিংয়ের জন্য ব্যবহৃত কাটার সেকশন ড্রেজারকে ক্যাপিটাল মেশিনারি হিসেবে ১ শতাংশ শুল্কে আমদানির সুযোগ রাখা।
এতে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে বলে মনে করছেন তারা।
করোনার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপকভাবেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ আয়কর প্রত্যাহারের দাবিও জানিয়েছেন তারা।
সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি এবং ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব উপজেলা পর্যায়ে আয়কর ও ভ্যাট অফিস স্থাপনের মাধ্যমে করজাল বৃদ্ধি, টিন নম্বরের পাশাপাশি ট্যাক্স পেমেন্টের প্রমাণ বা ডকুমেন্ট সরকারি-বেসরকারি কাজে বাধ্যতামূলক করা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পলিসি উইং এবং বাজেট বাস্তবায়ন উইংকে পৃথক করা, মূল্য সংযোজন কর আইন সহজ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনেরও সুপারিশ করেছে এফবিসিসিআই।