প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব ও কর্মসংস্থান সহায়ক হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যাটরা।
তারা বলেছেন, অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব কর ছাড় ও প্রণোদনার কথা ঘোষণা করেছেন, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
তবে কিছু কর প্রস্তাবে অসংগতি রয়েছে উল্লেখ করে সেগুলো সংশোধনের তাগিদও দিয়েছেন তারা। বলেছেন, সংশোধন না করলে প্রকারান্তে কার্যকর ‘করভার’ (ইফেক্টভি ট্যাক্স রেট) আরও বেড়ে যাবে। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।
চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যাটরা মনে করেন, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি ও জীবন-জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাই যে করেই হোক না কেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে বাজেটের সুফল মিলবে না।
শনিবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনায় এ মূল্যায়ন উঠে এসেছে পেশাজীবী সংগঠন ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যাট অব বাংলাদেশ- আইসিএবির কাছ থেকে।
আইসিএবির নেতারা মনে করেন, নতুন বাজেট ঘাটতিনির্ভর। এতে বেশি ঋণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে অর্থায়নের কথা বলা হয়েছে।
কর কাঠামোতে নানা দুর্বলতা ও অসংগতি দূর করতে একটি ‘ব্যয় কমিশন’ গঠনের প্রস্তাবও দেয় আইসিএবি। স্থানীয় ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আকর্ষণ করতে দীর্ঘ মেয়াদে ‘প্রগতিশীল কর নীতি’ প্রণয়নের পরামর্শও দেয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর মূল্যায়ন তুলে ধরেন যথাক্রমে আইসিএবির নির্বাহী সদস্য শাহাদাত হুসেইন ও স্নেহাশীষ বড়ুয়া। বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতি মাহমুদুল হাসান খসরু, সাবেক সভাপতি হুমায়ন কবির। সমাপনী বক্তব্য দেন আইসিএবির সদস্য সিদ্ধার্থ বড়ুয়া।
প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যায়নে আইসিএবি বলেছে, করপোরেট কর কমানোর ফলে বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে। তবে বাজেটে আগাম ভ্যাট ১ শতাংশ কমালেও অগ্রিম আয়কর কমানো হয়নি। এটা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ক্ষেত্রে অগ্রিম কর কমিয়ে সংশোধনের প্রস্তাব করেছে আইসিএবি।
প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর মূল্যায়নে আইসিএবি বলেছে, জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বিকাশ, নগদের মতো মুঠোফোন আর্থিক সেবাদাতার প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট করহার বাড়ানো হয়েছে। আইসিএবি মনে করে, এই কর বাড়ানোর প্রস্তাব কার্যকর হলে গ্রামের গরিব মানুষের এ-সংক্রান্ত সেবাখরচ বেড়ে যাবে। তাই আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর করহার কমানো উচিত।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে চাকরি দিলে কর ছাড়ের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। আইসিএবি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, ১০০ জনের পরিবর্তে ১০ জনকে চাকরি দিলে এর সুফল মিলবে। কারণ, এ দেশের অনেক কম প্রতিষ্ঠানই আছে যারা ১০০ জনকে একসঙ্গে চাকরি দেয়ার সামর্থ্য রাখে।
নারী উদ্যোক্তাদের বার্ষিক লেনদেনসীমা ৫০ লাখ থেকে ৭০ লাখ টাকায় উন্নীত করায় নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও উৎসাহিত হবেন এবং এসএমই খাত আরও বিকশিত হবে বলে মনে করে আইসিএবি।
মোবাইল অ্যাপসসহ তথ্যপ্রযুক্তির আরও পাঁচটি খাতকে নতুন করে কর অব্যাহতি সুবিধা দেয়ায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করে আইসিএবি।
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন খাতে কর প্রণোদনা অব্যাহতি সুবিধা ঘোষণা করায় দ্রুত শিল্পায়নের ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। তবে বাজেটে যেসব সুবিধা দেয়া হয়েছে, নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেছে আইসিএবি।
ভ্যাটে আগাম কর কমানো ও ফাঁকির জন্য জরিমানার বিধান শিথিল করায়ও সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছে আইসিএবি।
আইসিএবির সভাপতি মাহমুদুল হাসান খসরু বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে বিভিন্ন খাতে কর ছাড়কে আমরা স্বাগত জানাই। এতে করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু করোনা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে বাজেটে দেয়া সুযোগ-সুবিধার সুফল দেশের জনগণ পাবে না।’
আইসিএবির সাবেক সভাপতি হুমায়ন কবির বলেন, ‘অগ্রিম কর এখন ৫ শতাংশ। এটা অত্যন্ত বেশি, যা ব্যবসার খরচকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই কর না কমালে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ আসবে না।’
ভ্যাট বিভাগের সঙ্গে আয়কর বিভাগের কোনো সমন্বয় নেই। এখানে সমন্বয় জরুরি বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘আমাদের দেশে বৈষম্য বাড়ছে। সরকারি টাকা নানাভাবে অপচয় হচ্ছে।’
ব্যয় নিয়ন্ত্রণে একটি কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।
সংগঠনের সদস্য শাহাদাত হুসেইন বলেন, ‘বাজেটে ঋণের সুদ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৮ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। আবার প্রণোদনা প্যাকেজটি আসলে ঋণনির্ভর। এ অবস্থায় সরকার ঋণের ওপর বেশি নির্ভরশীল হওয়ায় ঘাটতির পরিমাণ বেশি, যা উদ্বেগজনক। ফলে আমাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরও বেশি বরাদ্দ দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘করপোরেট কর কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। তবে খেয়াল রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ যেমন: ভারত, ভিয়েতনাম ও চীনে করপোরেট কর ২০ থেকে ২২ শতাংশ। ফলে এই কর ক্রমান্বয়ে আরও কমিয়ে আনতে হবে। তা না হলে প্রতিযোগিতায় মানুষের টিকে থাকা কঠিন হবে।’