সরকারের ভর্তুকি, প্রণোদনা বা নগদ আর্থিক সহায়তা ছাড়া দেশের রপ্তানি খাত এগোতে পারছে না। অনেক খাত বছরের পর বছর নগদ সহায়তা পেয়েও টেকসই হচ্ছে না। আবার তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্য রপ্তানি খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও বিশেষ সুবিধা নেয়ার অভ্যাস পরিহার করতে পারছে না।
বর্তমানে ৩৭টি খাতে পণ্য রপ্তানিকারকদের ন্যূনতম ২ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিভিন্ন হারে নগদ আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে সরকার। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর রপ্তানি ভর্তুকি খাতে ৬ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছর এই ভর্তুকি আরও ৭.৬৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ছে। বাজেটে রপ্তানি ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
এর বাইরে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতিবছর বাজেটে কর ছাড়ের মতো সহায়ক নানারকম সুযোগসুবিধা রাখা হয়। রপ্তানিকারকরা যেমন নিয়ম করে চলমান সুবিধা বহাল, ক্ষেত্রভেদে আরও বৃদ্ধি এবং নতুন করে আরও খাতকে এই সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান, সরকারও তেমনি নিরাশ করে না রপ্তানিকারকদের।
রপ্তানি বাড়ানোর জন্য উৎসাহ দেয়ার পেছনে রপ্তানি ভর্তুকি খাতে নগদ আর্থিক সহায়তা দেয়ার এই প্রবণতা প্রতিবছরই বাড়ছে। এভাবে রপ্তানি খাতে বছরের পর বছর চলছে ভর্তুকি বরাদ্দ। তবে এই প্রণোদনা দিয়ে দেশের রপ্তানি খাতের খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না। বরং সরকারের আর্থিক সহায়তার ওপর খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের অতিনির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে রপ্তানি খাতের সম্প্রসারণ, বহুমুখীকরণ ও গুণগত মানোন্নয়নে উদ্যোক্তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও ঝুঁকি মোকাবিলার নিজস্ব সক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে না। এর ফলে দেশে টেকসই রপ্তানি খাত সৃষ্টি হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা।
তারা বলেছেন, নগদ আর্থিক সহায়তা দিয়ে রপ্তানি আয় বাড়ানোর চেষ্টা মোটেও স্থায়ী সমাধান নয়। কারণ ব্যবসা হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। নিজের চেষ্টাতেই তা মেলে ধরতে হবে। সেখানে বছরের পর বছর কোনো খাত বা খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা প্রণোদনায় ভর করে চললে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা হ্রাস পায়। এতে সরকারের প্রণোদনা দেয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও ব্যাহত হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রপ্তানি খাত চাঙা করার মাধ্যমে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সরকার এই ভর্তুকি সুবিধা দিয়ে থাকে।
‘কিন্তু আমাদের দেশে একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, নগদ সহায়তা না পেলে এগোতে পারছে না রপ্তানিকারকরা। তবে এটা ঠিক, ভর্তুকি, প্রণোদনা বা নগদ আর্থিক সহায়তা যে নামেই বলি না কেন, তা হলো তাৎক্ষণিক উৎসাহ প্রদান বা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সাময়িক সমস্যা সমাধানের একটি কার্যকর উদ্যোগ। তা হওয়া উচিত স্বল্প মেয়াদের জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো সম্ভাবনা বিবেচনার সুনির্দিষ্ট কিছু খাতের ক্ষেত্রে। সেটিও দীর্ঘ বছর ধরে চলতে পারে না। আবার সব সময় রপ্তানি ভর্তুকি দিয়ে রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টাও খুব একটা কার্যকর হয় না।’
তিনি বলেন, ‘দেশে এমন কিছু খাত রয়েছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে নারারকম সুযোগসুবিধা পেয়ে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেসব খাতে অনন্তকাল ধরে প্রণোদনা সুবিধা বহাল রাখা যৌক্তিকতার মধ্যে পড়ে না। বরং আমি মনে করি, এই অর্থ রপ্তানিকারক-শ্রমিক-কর্মচারীদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং এ-সম্পর্কিত সহায়ক উপকরণ সংশ্লিষ্ট কাজে প্রদান করা যেতে পারে।’
২০১৯-২০ অর্থবছর রপ্তানি খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা। তার আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছর এ খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছরগুলোতেও ভর্তুকি বরাদ্দ সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ গত তিন বছর রপ্তানি খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা ২০১৯ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ৩৭টি শ্রেণির ৪৭ ধরনের পণ্য এখন বিভিন্ন হারে প্রণোদনা পায়। এর মধ্যে আটটি পণ্য ২০ শতাংশ, পাঁচটি পণ্য ১৫ শতাংশ এবং ১৯টি পণ্য ১০ শতাংশ হারে প্রণোদনা পায়। বাকিগুলোতে দেয়া হয় ১ থেকে ৯ শতাংশ হারে প্রণোদনা।
এই সুবিধা দেয়া হয় কিছু ক্ষেত্রে বাজারভেদে আবার কিছুক্ষেত্রে পণ্যভেদে। প্রচলিত বাজারের বাইরে নতুন বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে দেয়া হয় ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা। আবার পণ্যভেদে দেয়া হয় আনুপাতিক হারের সুবিধা। এর মধ্যে আগর, আতর, আলু, হালাল মাংস, বৈচিত্র্যকৃত পাটপণ্য রপ্তানিতে দেয়া হয় ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা। মোটরসাইকেল, টুপি, সিরামিকসহ ৯টি পণ্যে সহায়তা দেয়া হয় ১০ শতাংশ হারে। শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ, প্রাকৃতিক রাবার ও লেটেক্স রপ্তানিতে প্রণোদনা দেয়া হয় ১৫ শতাংশ হারে, কাজুবাদাম, জীবন্ত কাঁকড়া ও কুঁচে মাছে ২০ শতাংশ, রিসাইকেল্ড পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার (পিএসএফ) ১৫ শতাংশ, ডিজেল ইঞ্জিনের জ্বালানি, ডিটারজেন্ট, প্রসাধনশিল্পে ব্যবহৃত হওয়া অপ্রচলিত লেচিথিন ও সয়া অ্যাসিড তেলে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া গরু-মহিষের নাড়িভুঁড়ি, শিং ও রগ রপ্তানির বিপরীতে ১০ শতাংশ, পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত কার্বনে ২০ শতাংশ, সফটওয়্যার, আইটিইএস ও হার্ডওয়্যারে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, জুস ব্লেন্ডার, এয়ারকুলার, এলইডি লাইট, ফ্যান ও সুইচ-সকেট রপ্তানিতেও রয়েছে ১০-১৫ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, সরকারের লক্ষ্য থাকে দেশ এগিয়ে যাক। একই সঙ্গে শিল্পোদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকরা ভালো করুক। তাই স্থানীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি আয় এবং কর্মসংস্থান বাড়াতেই সরকার রপ্তানি খাতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহমূলক এই প্রণোদনা দেয়।
তিনি জানান, এই প্রণোদনার কারণে সরকারের প্রতি কোনো উদ্যোক্তার বা রপ্তানি খাতের যাতে অতিনির্ভরতা তৈরি না হয়, সে জন্য প্রতিবছরই নগদ অর্থ সহায়তার জন্য বিবেচিত রপ্তানিখাতগুলো পুনর্নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে প্রণোদনার শতকরা হারও পুনর্বণ্টন করা হয়। এর পাশাপাশি এই প্রণোদনা পেয়ে কোন খাত ভালো করল, কারা খারাপ করল সেটিও যাচাইবাছাই করে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় কিছু নতুন খাত সংযুক্ত করা হয় এবং ব্যর্থ খাতগুলোকে সুবিধার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।
উদাহরণ টেনে ইপিবির এই ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, গত অর্থবছর ২৪টি পণ্যকে নতুন করে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ১৪টি একেবারেই নতুন, কোনো প্রণোদনা পেত না। আবার সম্ভাবনা ভালো, কিন্তু সুবিধা কম এমন ১০টি খাতে প্রণোদনা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এমন কিছু খাত আছে, যারা বহু বছর ধরে পাচ্ছে, তাদের অনুকূলে প্রণোদনার হার প্রতিবছর কমিয়ে আনা হচ্ছে।