করোনাভাইরাস মহামারিতে এক বছরের বেশি সময় অর্থনৈতিক অচলাবস্থা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকিং খাতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি থেকে মার্চ) শেষে অধিকাংশ ব্যাংক মুনাফায় রয়েছে।
আমানতের সুদহার কমানো, প্রভিশন সংরক্ষণে ছাড়, ব্যয় সংকোচনের কারণে মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কাগজে-কলমে মুনাফা দেখানো হলেও বাস্তবতা ভিন্ন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত ৩১ ব্যাংকের মধ্যে ২০টি তাদের প্রথম প্রান্তিকের আয় প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ১৫টির আয় গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। একটি ব্যাংকের আয় প্রায় তিন গুণ হয়েছে। একটির হয়েছে দ্বিগুণ। এ ছাড়া দেড় গুণ হয়েছে আরও বেশ কিছু ব্যাংকের শেয়ারদর।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি ও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো আগের বছরের তুলনায় খরচ অনেক কমিয়েছে। ব্যালান্স শিট ভালো ম্যানেজ করেছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল খরচ কমানো, সেটা আমরা পেরেছি।
‘এর বাইরে প্রথম প্রান্তিকে বেতন খরচ ছাড়া অন্যান্য অপারেটিং খরচ কমিয়ে আনা হয়েছে। এটার প্রভাব পড়েছে অনিরীক্ষিত মুনাফার হিসাবে। তবে খুব ভালো মুনাফা করেছে সেটা না; সামান্য মুনাফা করেছে।’
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আরফান আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকে তারল্য ঘাটতি নেই। ফিক্সড ডিপোজিটে ইন্টারেস্ট রেট লো। করোনার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া সুবিধার কারণে ব্যাংকগুলো বাড়তি প্রভিশনিং (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) করে নাই। এ কারণে মুনাফা বাড়তি দেখাতে পেরেছে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের ব্যবসা যে ভালো হচ্ছে, এ রকম না। ডিপোজিট এখন পর্যাপ্ত রয়েছে। কম রেটেও পাওয়া যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূল কারণ হলো আমানতে সুদহার অনেক কম। ঋণ বিতরণ একদম হচ্ছে না, সেটা নয়।
‘যাতায়াত ভাতা, আনুষঙ্গিক খরচ, বিভিন্ন অনুষ্ঠান এগুলো কমিয়েছে। তবে ব্যাংকের ব্যয় যে খুব কমেছে, সেটা নয়।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বিষয়ে ছাড় দিয়েছিল। ফলে ব্যাংকগুলোর প্রভিশনিং করতে হয়নি, যার প্রভাব মুনাফায় পড়েছে।
‘তবে এ ধরনের ছাড়ে ব্যাংকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ব্যাংকের ঝুঁকি বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলো পরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
ব্যাংকের আয়
ব্যাংকগুলো নিজেদের মূলধন ও সঞ্চয়কারীদের আমানত ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করে আয় করে। আয়ের ৯০ শতাংশই আসে ঋণের সুদ থেকে। বাকি ১০ শতাংশ আসে কমিশন, বৈদেশিক মুদ্রা ও অন্যান্য খাত থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালে মূলধন থেকে ব্যাংকগুলোর আয়ের অনুপাত ছিল ৬ টাকা ৮ পয়সা। ২০২০ সালে তা হয় ৬ টাকা ২০ পয়সা।
মূলধন থেকে আয় কমার শীর্ষে রয়েছে সরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংক। কারণ এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেশি।
সরকারি ব্যাংকগুলোর ২০১৯ সালে ১০০ টাকা পুঁজি খাটিয়ে লোকসান হয়েছে ১৩ টাকা ৭০ পয়সা। ২০২০ সালে ১০০ টাকা পুঁজি খাটিয়ে লোকসান দিয়েছে ১৫ টাকা ২০ পয়সা।
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ২০১৯ সালে ১০০ টাকা পুঁজি খাটিয়ে লোকসান দিয়েছে ১৭ টাকা। ২০২০ সালে দিয়েছে ২৬ টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ২০১৯ সালে আয় ১১ টাকা ২০ পয়সা। ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ টাকায়।
বিদেশি ব্যাংকগুলো ২০১৯ সালে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে আয় করেছিল ১৩ টাকা ৪০ পয়সা। গত বছর তা হয়েছে ১৩ টাকা ৫০ পয়সা।
ঋণের বিপরীতে সুদ আয়
ঋণের সুদ থেকে ব্যাংকের আয়ের বড় অংশ আসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী, নিয়মিত ঋণের সুদ আদায় না হলেও ব্যাংক আয় খাতে নিতে পারে। গত বছর ঋণের সুদহার থেকে ব্যাংকের তেমন কোনো আয় হয়নি। অথচ এ খাত থেকে সুদ আদায় দেখানো হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই কাগজে-কলমে।
আবার ঋণখেলাপি হয়ে গেলে সে ঋণের সুদ আদায় না হলে সেটিকে আয়ের খাতে নিতে পারে না ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে গত বছরে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে খেলাপি হননি কোনো গ্রাহক। ফলে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে কোনো ঋণখেলাপি হয়নি। এতে ওইসব ঋণের সুদ তারা আয় খাতে নিতে পারছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের আয় কিছুটা বেড়েছে।
ঋণের বিপরীতে গত বছর সুদ থেকে আয় কমেছে। ২০১৯ সালে ১০০ টাকার সম্পদ বা ঋণ থেকে সুদ আয় হয়েছে ৪০ পয়সা। ২০২০ সালে সেটা কমে হয় ৩০ পয়সা।
সরকারি ব্যাংকগুলোর ২০১৯ সালে সুদ আয়ে ১০০ টাকায় লোকসান হয়েছে ৬০ পয়সা। গত বছরের তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ২০১৯ সালে লোকসান ছিল ৩ টাকা ৩০ পয়সা। গত বছর লোকসান হয়েছে ৫ টাকা ৩০ পয়সা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ২০১৯ সালে আয় হয়েছিল ১০০ টাকায় ৮০ পয়সা। ২০২০ সালে আয় হয়েছে ৫০ পয়সা।
বিদেশি ব্যাংকগুলোরও ২০১৯ সালে ১০০ টাকায় আয় হয়েছিল ২ টাকা ৩০ পয়সা। গত বছর আয় হয়েছে ২ টাকা ২০ পয়সা।
ব্যয় সংকোচন
ব্যাংকাররা দাবি করছেন, তারা ব্যয় সংকোচন করেছেন।
ব্যয় সংকোচনের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে আমানতের সুদ কমানো। বর্তমানে ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে ব্যাংকগুলো।
তবে তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে খরচ করেছে ৭৮ টাকা। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮৪ টাকা ১০ পয়সা।
এর মধ্যে সরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২০১৯ সালে ১০০ টাকা আয় করে খরচ করেছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। ২০২০ সালে তা আরও বেড়ে খরচ হয়েছে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা।
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ২০১৯ সালে ১০০ টাকা আয় করে খরচ করেছে ১৫৯ টাকা ৮০ পয়সা। ২০২০ সালে তা আরও বেড়ে খরচ করেছে ১৮৯ টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো ২০১৯ সালে ১০০ টাকা আয় করে খরচ করেছিল ৭৭ টাকা ৬০ পয়সা। ২০২০ সালে খরচের পরিমাণ আরও বেড়ে ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে হয়েছিল ৮২ টাকা ৬০ পয়সা।
বিদেশি ব্যাংকগুলোর খরচ কমেছে। ২০১৯ সালে ১০০ টাকা আয় করে তারা খরচ করেছে ৪৮ টাকা ৮০ পয়সা। ২০২০ সালে ১০০ টাকা আয় করে খরচ করেছে ৪৫ টাকা ৫০ পয়সা।
করোনার ধাক্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার কমেছে। ফলে মানুষের বিদেশ ভ্রমণ, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে বা চিকিৎসার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি ও কমিশন থেকেও কমেছে আয়।
নিরাপত্তা সঞ্চিতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকিং খাতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণের দরকার ছিল ৬৪ হাজার ৮০১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। কিন্তু এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণে সক্ষম হয়েছে ৬৪ হাজার ৬৭৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ফলে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে মাত্র ১২৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
এ সময়ে ১১টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত, দুটি বিশেষায়িত ও ছয়টি বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৪৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে পাঁচ হাজার ৪২৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। আর বেসরকারি ছয় ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ এক হাজার ৫৫১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৬৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণের মানভেদে নিরাপত্তা সঞ্চিতির হার ৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। যেহেতু খেলাপি ঘোষণা করা যায়নি, তাই এই সঞ্চিতি সংরক্ষণের দরকার পড়েনি। ফলে ব্যাংকের ব্যালান্স শিট মহামারিকালে আগের বছরের চেয়ে ভালো দেখাচ্ছে।
গত বছরের মার্চে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কেউ কিস্তি না দিলেও খেলাপি করা যাবে না। পরে তিন দফায় এই নির্দেশনার কার্যকারিতা বাড়িয়ে আগামী জুন পর্যন্ত করা হয়।
তারল্যের পাহাড়
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংক খাতে তারল্য দাঁড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকা, এক মাস আগে যা ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৭০ কোটি টাকা। আর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা।
বিশাল এই তারল্যের একটি বড় অংশ বিল বন্ডে বিনিয়োগ করেছে। বাকি টাকা ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে আছে।
গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে গ্রাহকদের ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তোলার চাহিদা অনেক বেড়েছে। তারপরও ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে আছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, এর কারণ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বছরের শুরুতে ঋণের চাহিদা কিছুটা বাড়লেও বর্তমানে এই চাহিদা আবার কমতে শুরু করেছে।
আমানতের ঢল
ব্যাংকে আমানতকারীদের টাকা জমা রাখার প্রবণতা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমানত বেড়েছিল ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
এর মধ্যে চলতি আমানত গত অর্থবছরে কমেছিল ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে একই সময়ে বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
মেয়াদি আমানত গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।