স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নিতে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের মতো ঋণ নিয়েছে।
এর মধ্যে এই প্রথম বাংলাদেশ ২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে।
গত ২৩ মে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ৪১৪তম সভায় সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বিপক্ষীয় কারেন্সি সোয়াপ সুবিধা প্রদান-সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের খসড়াটি পাস হয়েছে।
যেভাবে ঋণ দেয়া হচ্ছে, সেটি সাধারণত দুর্বল অর্থনীতির দেশকে দেয়া হয়। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ ও মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তবে এখনও বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ শ্রীলঙ্কাকে রিজার্ভ থেকে সোয়াপের আওতায় বিনিয়োগ বা ঋণসুবিধা দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন এটি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আরও আলোচনা হবে। একই সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও আলোচনা হবে। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
গত এক দশকে বাংলাদেশে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। ছবিটি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে কখনও এভাবে কোনো দেশকে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়া হয়নি। শ্রীলঙ্কা আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। তারা আকুরও সদস্য। সুতরাং এ ঋণ দেয়া হলে আমাদের তেমন সমস্যা হবে না। তবে এ ক্ষেত্রে সতর্কতা দরকার।’
তিনি বলেন, লেনদেনে মুদ্রার ধরন কত দিনে কী প্রক্রিয়ায় পরিশোধ, অন্য দেশের উদাহরণ কী, দেশের আমদানি ব্যয় মেটাতে প্রয়োজন হবে কি না, এসব বিষয়ে সমীক্ষার পরই ঋণ দেয়া উচিত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন রিজার্ভের পরিমাণ ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। ভালো অবস্থানে আছে। তাই শ্রীলঙ্কাকে অর্থ দেয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেই। বাংলাদেশ এর আগে কখনও কোনো দেশকে রিজার্ভের অর্থ দেযনি। তবে আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে এ ধরনের লেনদেন ছিল।’
দুর্বল দেশকে সহযোগিতার অংশ হিসেবে এই ঋণ
বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগের আন্তর্জাতিক উপকরণ সোয়াপের (সাময়িক সময়ের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ) আওতায় এ ঋণ সুবিধা দিচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার দিক থেকে অতি দুর্বল দেশের পাশে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবে কারেন্সি সোয়াপ গঠন করা হয়।
সোয়াপের আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশ বৈদেশিক মুদ্রাসংকটে ভুগলে এর আওতায় ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা নিতে পারে।
এটি প্রথমে দেয়া হয় তিন মাসের জন্য। পরে এর মেয়াদ দুই পক্ষের সম্মতিতে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
নিজ অর্থে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারি বন্ডে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। কিন্তু কোনো দেশের সরকারকে বিনিয়োগ সুবিধা দেয়া হয়নি।
শ্রীলঙ্কা এর আগে ২০১৫ সালে ভারত থেকে সোয়াপের আওতায় সে দেশের রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগ সুবিধা নিয়েছিল।
সুদ কত
সমঝোতা স্মারকটি হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ২০ কোটি ডলার ধার দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ধারের জন্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে লাইবরের (লন্ডন আন্তব্যাংক সুদের হার) সঙ্গে অতিরিক্ত ২ শতাংশ সুদ যুক্ত করে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ করবে।
তিন মাসের বেশি সময়ের জন্য দিতে হবে লাইবরের সঙ্গে অতিরিক্ত আড়াই শতাংশ সুদ।
বর্তমানে লাইবর রেট ২ শতাংশের কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিয়োগের বিপরীতে গ্যারান্টি দেবে শ্রীলঙ্কার সরকার ও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ২০ কোটি ডলার সমমূল্যের শ্রীলঙ্কান রুপি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লিয়েন হিসেবে জমা থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করবে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কা।
বাংলাদেশ একই সঙ্গে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার একটি কর্ণফুলী টানেল
প্রস্তাব মুজিব শতবর্ষে
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত মার্চে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরও ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময়ে তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি প্রস্তাব দেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা রাজি হওয়ার পরে শ্রীলঙ্কার সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠায়।
শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ-সংকটে ভুগছে। বর্তমানে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ৫০০ কোটি ডলার। এ রিজার্ভ দিয়ে তাদের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। রিজার্ভকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রাখতে হয়।
বাংলাদেশও আগে নিয়েছে এই ঋণ
বাংলাদেশ ২০০১ সালে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়লে দেশের রিজার্ভ ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। তখন বাংলাদেশ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। তখন আকুর সঙ্গে বাংলাদেশ প্রথম সোয়াপ করে।
আকুর সদস্যদেশগুলো বাকিতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালায়। প্রতি দুই মাস পরপর দেনা-পাওনা সমন্বয় করে।
বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। যা দিয়ে কমপক্ষে ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৫৩৬ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশের রিজার্ভ। আর পাকিস্তানের রিজার্ভের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার। নেপালের রিজার্ভ উন্নীত হয়েছিল ১১ বিলিয়ন ডলারে।
শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০১৮ সালের এপ্রিলে। সে সময় দেশটির রিজার্ভ ছিল ৯ বিলিয়ন ডলার। তবে করোনাকালে সেটি প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে।