করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক মহামন্দা। দেশে দেশে অসংখ্য মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে নিয়মিত আয় থেকে ছিটকে পড়েছেন। অনেকে নতুন করে দরিদ্র্য পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। তবে এর মধ্যেও বেড়ে চলেছে স্বর্ণের দাম।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, অতি দামি বলে স্বর্ণ বা স্বর্ণালঙ্কার হচ্ছে বিলাসী পণ্য। বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ভোক্তাই এই বিলাসী পণ্যের ক্রেতা হতে পারেন না। করোনা পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাজারে সোনার কেনার ক্রেতা এখন স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে তাতে স্বর্ণের দামে লাগাম পড়েনি।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ ভোক্তাপর্যায়ে সোনার কেনাকাটা হয় গহনাসামগ্রীতে। এই শ্রেণির ক্রেতার কাছে গহনাসামগ্রীর চাহিদা গত বছরের তুলনায় চলতি বছর কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে, বৈশ্বিকভাবে সোনার সরবরাহ কমেছে ৩ শতাংশের মতো।
তবে এর পরেও আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের চাহিদা যেমন বেশি, তেমনি বিক্রি হার এবং আউন্সপ্রতি দামও বেড়েছে।
গত শনিবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দর ওঠে ১৮৮২ আমেরিকান ডলার। রোববার বিকাল সোয়া ৫টায় দাম আরও বেড়ে একই পরিমাণ সোনার দর পৌঁছায় ১৮৮৭ ডলারে। অবশ্য সন্ধ্যা ৭টায় তা কমে শনিবারের নির্ধারিত সীমায় ফিরে আসে। তবে সোমবার দিনভর সোনার দাম ফের বেড়ে ১৮৮৪ ডলার থেকে ১৮৮৬ ডলারে ওঠানামা করেছে। সন্ধ্যায় তা আবার ১৮৮২ ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করে।
গত দেড় বছর ধরে সোনার দাম ওঠানামায় অস্বাভাবিকতা অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছর ২১ মে পর্যন্ত গত ১৭ মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দর ১১ বার বেড়েছে এবং ৯ বার কমেছে। তবে যে হারে বেড়েছে, কমেছে তার চেয়ে অনেক কম। ফলে সাধারণের ক্রয় সক্ষমতা এবং নাগালের বাইরে রয়েছে সোনার দাম।
ধাতু পণ্যের স্বীকৃতি সংস্থা গোল্ডম্যান সাকস বলছে, ২০২০ সালের তুলনায় এ বছর সোনার দাম বাড়বে ২২ শতাংশ পর্যন্ত। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে এক আউন্স সোনার দর চলতি বছরের মধ্যে বেড়ে ২ হাজার ৩০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে।
গোল্ডম্যান সাকস এই প্রক্ষেপন, স্বর্ণের মাত্রাতিরিক্ত দামের কারণ জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। এতে দেখা গেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ক্রেতা স্থানীয় বাজারে স্বর্ণ কিনতে পারছে না। তবে এর পরেও বিশেষ কিছু কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে।
দেশে এ খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ী ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের স্বত্বাধিকারী এবং বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা নিউজবাংলাকে জানান, সোনার বাজারটি অন্যসব পণ্যের মতো নয়। এখানে ভোক্তার আচরণও অস্বাভাবিক রকমের হয়।
তিনি বলেন, ‘জেনারেল কনজিউমারদের পার্টিসিপেশন এই বাজারে মুখ্য নয়। বিশ্বে বিভিন্ন দেশের দায়িত্বশীল এজেন্ট ও বায়াররাই সোনার বাজারের মূল নিয়ন্ত্রক। বিশ্ব যখন স্থিতিশীল থাকে তখন সোনা কেনার প্রতি এদের চাহিদা কম থাকে। যখনই বিশ্ব সংকটের মুখোমুখি হয় তখন নিজ নিজ দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অনুমোদিত লোকাল এজেন্টরা ক্রেতা সেজে হাজার হাজার কেজি সোনা কিনে মজুদ রাখে। এভাবে সব দেশ যখন এক সঙ্গে বিপুল পরিমাণ সোনা কেনার তৎপরতা চালায়, তখন চাহিদা ও যোগানের ফর্মূলা অনুযায়ীই সোনার দাম বাড়তে থাকে।’
সংকটকালে কেন সোনা মজুদের প্রবণতা তৈরি হয়, জানতে চাইলে, আগারওয়ালা বলেন, কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে, পরাক্রমশালী দেশ বা অর্থনীতির কোনো কারণে ঝুঁকির আশংকা থাকলে বা বিশ্ব প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হলে আর্থিক মন্দা বা মহামন্দা দেখা দেয়। তখন দেশে দেশে উদ্যোক্তার সক্ষমতা এবং ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে নানা ধরনের আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা হয়। এতে খোলাবাজারে নগদ অর্থের আধিক্য বাড়ে এবং এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কাও থাকে; যার দরুণ আর্থিক খাতকেন্দ্রিক নানা সমস্যা তৈরি হয়।
‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের সঞ্চিত রিজার্ভ এবং সোনার মজুদ দেশকে নিরাপদ রাখে। ফলে এই ভয়-আতঙ্ক সামাল দিতেই যে কোনো সংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি অংশ সংরক্ষণ করে বলে সার্বিকভাবে সোনা কেনার প্রবণতা বাড়ে। আবার যাদের মজুদ বেশি আছে তারা এই সময়ে বাড়তি দামে বিক্রিও করে। দীর্ঘমেয়াদি করোনা পরিস্থিতিতেও এখন তাই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। যার প্রভাব দেশেও পড়েছে।’
জানা গেছে, অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘ হলে এবং এর থেকে মূল্যস্ফীতি বাড়ার ভয় তীব্র হলে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখতে আর্থিক কর্তৃপক্ষের কাছে অর্থের চেয়ে ক্ষয়হীন সোনার মজুদের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। কারণ, অর্থের (টাকা বা ডলার) মান যে কোনো সময় অবনমন হতে পারে, কিন্তু সেই অর্থে মজুদ সোনার কোনো ক্ষয় হয় না।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সংকটকালে সোনার মজুদ বাড়াতে পারলে সংশ্লিষ্ট দেশ অর্থনৈতিকভাবেও অন্যের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। কেননা, পরে দাম বেশি পেলে ওই সোনা বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। তবে কোন কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী পরিমাণ সোনা কিনছে বা বিক্রি করছে তা খুব একটা বাইরে প্রকাশ পায় না।
অর্থনীতিবিদদের দাবি, স্বর্ণ কিনে কারও লোকসান হয়েছে বা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন নজির বিশ্বে নেই। একই কথা সাধারণ ভোক্তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ কারণে করোনা মহামারিতে মানুষের আয় ও স্বাভাবিক বিনিয়োগ কমে গেলেও সামর্থ্যবানেরা স্বর্ণ বা স্বর্ণালঙ্কার মজুদে বিনিয়োগ করছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রায় সব দেশে বহু কাল ধরেই মানুষ নিরাপদ ভেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করছে।
স্বর্ণমান ও ভোক্তার আচরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুজন অর্থনীতিবিদ গবেষণা করেছেন। ‘গোল্ডেন ডিলেমা’ নামে ওই গবেষণায়ও দাবি করা হয়, সংকটকালে সোনার দাম বাড়ে। ভয় বা আতঙ্কের কারণেই এটা হয়, যা ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর থেকে দৃশ্যমান হতে দেখা গেছে।
বাজার পর্যবেক্ষকেরা জানান, স্বর্ণের কেনাকাটায় স্থানীয় বাজারে নিয়ন্ত্রণ খুব একটা না থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে যাতে কোনো ‘বাবল’ তৈরি হতে না পারে সেজন্য সিলিং বেঁধে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে ১৯৯৯ সালে ওয়াশিংটন চুক্তি নামে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিও রয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক বছরে ৪০০ টন বা ৪০০০ কেজির বেশি স্বর্ণ বিক্রি করতে পারবে না।