পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৪৯ কোটি ৭০ লাখ (প্রায় ১৪.৫ বিলিয়ন) ডলার।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি।
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে আমদানি কমায় কিছুদিন পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি নিম্মমুখী ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাসে আমদানি বাড়ায় এই ঘাটতি ফের ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।
আর এর ফলে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) উদ্বৃত্ত এখন নেই বললেই চলে। মাত্র ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার রয়েছে এই উদ্বৃত্ত।
তবে আমদানি বাড়াকে অর্থনীতির জন্য ‘ভালো’ হিসেবেই দেখছেন অর্থনীতির দুই গবেষক আহসান এইচ মনসুর ও জায়েদ বখত।
তারা বলেছেন, আমদানি বাড়া মানে দেশে বিনিয়োগ বাড়া; অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার হওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার। শতাংশ হিসাবে এ সময়ে ঘাটতি বেড়েছে ২০ শতাংশ।
প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ করেছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তা কমে ৬৪৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারে নেমে আসে। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ৮২২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সেই ঘাটতি বেড়ে ৯৭৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারে ওঠে।
আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ জুলাই-মার্চে তা আরও বেড়ে হয়েছে ১৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
এই ৯ মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ২ হাজার ৮২৭ কোটি ২০ লাখ ডলার আয় করেছে। আর আমদানিতে ব্যয় করেছে ৪ হাজার ২৭৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
এই সময়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে মাত্র দশমিক ০৬ শতাংশ। আর আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ।
অথচ আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানি বেড়েছিল ১ দশমিক ৯১ শতাংশ। রপ্তানি আয় কমেছিল দশমিক ১২ শতাংশ।
জুলাই-মার্চ সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ছিল ১৭০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ছিল ১৩৭ কোটি ডলার। ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এ খাতে ঘাটতি ছিল ১০৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চে এই ঘাটতি ছিল ২৩৬ কোটি ডলার।
মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।
ব্যালান্স অব পেমেন্ট তলানিতে
বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) বড় উদ্বৃত্ত আর ধরে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ।
অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) এই সূচকের উদ্বৃত্ত মাত্র ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল ১৩৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি বাড়ায় লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল ৪৮৪ কোটি ৯০ লাখ (প্রায় ৫ বিলিয়ন) ডলারের বড় ঘাটতি নিয়ে। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছর শুরু হয় উদ্বৃত্ত দিয়ে। প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৫৩ কোটি ৪০ লাখ (৩ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন) ডলার।
এর পরের তিন মাস ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তা ৪৩২ কোটি ২০ লাখ (৪ দশমিক ৩২ বিলিয়ন) ডলারে উঠে।
কিন্তু দেশে করোনাভাইরাস মহামারির প্রথম ঢেউয়ের প্রকোপ কমতে থাকলে আমদানি বেড়ে যায়। সে কারণে জানুয়ারি শেষে অর্থাৎ জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সেই উদ্বৃত্ত ২২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারে নেমে আসে।
ফেব্রুয়ারি শেষে যা আরও কমে ১৫৫ কোটি ৭০ লাখ ডলারে নেমে আসে। সর্বশেষ জুলাই-মার্চে তা আরও কমে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে।
আমদানি বাড়ায় লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত কমছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিতষ্ঠানের (বিআইডিএসস) গবেষক রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, অর্থবছরের বাকি তিন মাসে আমদানি বাড়লে গত অর্থবছরের মতো এবারও লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে। তবে গতবারের মতো অত বড় ঘাটতি হবে না।
তিনি বলেন, ‘আশার কথা হচ্ছে, কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। সবাই বুঝতে পেরেছে, করোনাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে। সে কারণে আমদানিতে যে মন্দাভাব ছিল, সেটা আর নেই। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো।’
আরেক অর্থনীতিবিদ গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদানি বাড়া মানে দেশে বিনিয়োগ বাড়া, অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার হওয়া। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া।’
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ছিল ৫১০ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
রেমিট্যান্সে ঢল
মহামারির মধ্যেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে। প্রতি মাসেই বাড়ছে এই অংক। অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে এই সূচক।
অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) ১ হাজার ৮৬০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছর এই নয় মাসে পাঠিয়েছিলেন ১ হাজার ৩৭৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক ০৬ শতাংশ।
প্রতি সপ্তাহেই রেমিট্যান্স প্রবাহের তথ্য প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ঈদের আগে এই সূচক আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। চলতি মে মাসের ১২ দিনেই (১ থেকে ১২ মে) ১২২ কোটি ৪২ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
সবমিলিয়ে অর্থবছরের দশ মাস ১২ দিনে (২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ১২ মে) ২ হাজার ১৮৯ কোটি (প্রায় ২২ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে।
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্য
তবে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে (ওভারঅল ব্যালেন্স) এখনও বড় উদ্বৃত্ত রয়েছে। অর্থবছরের নয় মাসে এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৯৯ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল মাত্র ৬২ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
আর্থিক হিসাবেও বড় উদ্বৃত্ত
আর্থিক হিসাবেও (ফাইন্যানশিয়াল অ্যাকাউন্ট) বড় উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
অর্থবছরের তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৭৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল। জুলাই-নভেম্বর সময়ে তা ৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার উদ্বৃত্তে চলে আসে। ছয় মাসে সেই উদ্বৃত্ত বেড়ে হয় ২২০ কোটি ১০ লাখ ডলার।
সাত মাসে তা আরও বেড়ে ৪৪৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার হয়। আট মাসে উদ্বৃত্ত ছিল ৫৬১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। নয় মাস শেষে তা আরও বেড়ে ৬৯৪ কোটি ২০ লাখ ডলার হয়েছে।
গত বছরের এই নয় মাসে ৩৪৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।