বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

৯ মাসেই ৮৬ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি

  •    
  • ২০ মে, ২০২১ ০০:৪২

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা মহামারিতে মানুষের আয় কমে গেছে। তা ছাড়া মুনাফার ওপর করের হার বৃদ্ধি এবং নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কেন এই উল্লম্ফন- অর্থনীতিবিদরা তার সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে রেকর্ডের পর রেকর্ড হচ্ছে। অস্বাভাবিক বিক্রি বাড়ায় এই রেকর্ড গড়ছে ‘সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ’ হিসেবে পরিচিত এই খাতে বিনিয়োগ। আর এতে বাড়ছে সরকারের ঋণের বোঝা।

চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট ৮৬ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই ৯ মাসে এত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি।

৯ মাসের বিক্রির এই অঙ্ক ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, জুন-জুলাই) চেয়ে ২৭ শতাংশ বেশি।

শুধু তা-ই নয়, একক মাস হিসাবেও সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে গত মার্চ মাসে। এই মাসে ১০ হাজার ৭৬২ কোটি ৫৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর আগে কখনো এক মাসে এত বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেননি ক্রেতারা।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বুধবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত) ৮৫ হাজার ৯৯০ কোটি ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৫২ হাজার ৯৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা শোধ করা হয়েছে।

এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ২০ কোটি টাকা।

মার্চে ১০ হাজার ৭৬২ কোটি ৫৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। সুদ-আসল বাবদ গ্রাহকদের শোধ করা হয় ৬ হাজার ৮৭১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। সে হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৮৯১ কোটি ২৮ লাখ টাকা।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা মহামারিতে মানুষের আয় কমে গেছে। তা ছাড়া মুনাফার ওপর করের হার বৃদ্ধি এবং নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কেন এই উল্লম্ফন- অর্থনীতিবিদরা তার সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি মাসেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। আমার কাছে এটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এই মহাসংকটের সময়ে কেন বাড়ছে, তা আমি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি না।

‘মহামারিতে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। এর মধ্যেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সত্যিই বিস্ময়কর।’

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় সরকারের জন্য একটি বিপদ হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বিক্রির এই উল্লম্ফনের ফলে সরকারকে গ্রাহকদের প্রচুর সুদ দিতে হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে সরকারের ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝা। এই “বোঝা” কমাতে সরকার নানা সময়ে নানা উদ্যোগ ও কড়াকড়ি আরোপ করলেও সঞ্চয়পত্র বিক্রির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।’

জায়েদ বখত বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে একটি মত আছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অনেক বেশি। এটি কমানো ছাড়া বিক্রি কমানো যাবে না। পরিবার ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য সব সঞ্চয়পত্রের সুদের হার এখনই কমানো উচিত বলে আমি মনে করি। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রির চাপ কোনোভাবেই কমানো যাবে না।’

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এই কঠিন সময়ে মানুষ টাকা পাচ্ছে কোথায়? বুঝতে পারছি না।’

তবে এর দুটি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন মনসুর। বলেন, প্রথমত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের একটি অংশ দিয়ে মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনছে। আগেও কিনত। তবে এখন রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় এই অঙ্ক বেড়েছে। এ ছাড়া অন্য যেকোনো সঞ্চয় প্রকল্পের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যেহেতু বেশি, সবাই এখানেই বিনিয়োগ করছে।

সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার এখন জাতীয় পরিচয়পত্র এবং টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করেছে। তা ছাড়া ব্যাংক হিসাব ছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না।

এখন আর কেউ ভুয়া নামে বা একই ব্যক্তি বিভিন্ন নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম; ৩ থেকে ৫ শতাংশের মতো। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে সুদ মিলছে ১১ থেকে ১২ শতাংশ।

পুঁজিবাজারে কিছুদিন ধরে তেজিভাব দেখা দিলেও এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি।

সব মিলিয়ে বেশি মুনাফার কারণেই সবাই সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করেন আহসান মনসুর ও জায়েদ বখত।

বিক্রির চাপ কমাতে গত বছরের ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ফলে কমতে শুরু করে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি।

কিন্তু এই অর্থবছরের শুরু থেকেই তা আবার বাড়ছে তো বাড়ছেই।

বিক্রি কমাতে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ‘বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র’ নামের একটি সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার।

এখন থেকে কোনো ব্যাংকের শাখা বা ডাকঘর থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি ‘বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র’ কেনা যাবে না। শুধু জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের আওতাধীন সঞ্চয় ব্যুরো থেকে এই সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ৬৭ হাজার ১২৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। তার আগের অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৩৪২ কোটি ৩৯ লাখ টাকার; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিক্রি।

আহসান মনসুর বলেন, বিক্রি যেভাবে বাড়ছে, এটা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে এবার মোট বিক্রি ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৮ হাজার ৭০৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। আগস্টে বিক্রি হয় ৮ হাজার ৮৫২ কোটি ২৯ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ১০ হাজার ৩৮৭ কোটি ৬২ লাখ টাকায় ওঠে।

এর পরের তিন মাস অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে বিক্রি হয় যথাক্রমে ৯ হাজার ২৪৯ কোটি ৮৬ লাখ, ৯ হাজার ৫৪৭ কোটি ৬২ লাখ এবং ৮ হাজার ২৩৩ কোটি ১৭ লাখ টাকার।

জানুয়ারিতে বিক্রি হয় ১০ হাজার ৬৪৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, এক মাসের হিসাবে যা ছিল এত দিন সবচেয়ে বেশি বিক্রি।

ফেব্রুয়ারিতে বিক্রি হয় ৯ হাজার ৬০৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকার। সর্বশেষ মার্চে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১০ হাজার ৭৬২ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় উঠেছে।

লক্ষ্যের ৬৫ শতাংশ বেশি ঋণ

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্থবছরের এই ৯ মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ২০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে ১২৯ শতাংশ বেশি। আর বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে বেশি ৬৫ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৪২৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

সঞ্চয় অধিদপ্তর ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মোট লক্ষ্য ধরেছে ৮৬ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে সুদ-আসল বাবদ শোধ করতে হবে ৬৬ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ২০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা।

অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার এই ২০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে।

হিসাব-নিকাশ করে দেখা যাচ্ছে, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল, তার ৬৫ শতাংশ ঋণ ৯ মাসেই নিয়ে ফেলেছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। বিক্রি কমায় বছরের মাঝামাঝিতে এসে সেই লক্ষ্য কমিয়ে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

কিন্তু গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে হঠাৎ করেই বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ অর্থবছর শেষে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকে।

কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা বাংলাদেশে লাগতে শুরু করার পর গত বছরের এপ্রিলে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি তলানিতে নেমে আসে। ওই মাসে মোট ৬৬১ কোটি ৭৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। সুদ-আসল বাবদ শোধ করা হয় তার প্রায় দ্বিগুণ ১ হাজার ২৮৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। নিট বিক্রি ছিল ৬২১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)।

অর্থাৎ এপ্রিল মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল তার থেকে ৬২১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা বেশি গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদে শোধ করা হয়েছিল।

মে মাসে ৩ হাজার ২২৬ কোটি ৯০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। সুদ-আসল বাবদ শোধ করা হয় ২ হাজার ৭৯৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৩০ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

জুনে মোট বিক্রি মে মাসের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেড়ে ৯ হাজার ৩২২ কোটি ৮০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়।

বর্তমানে দেশে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র প্রচলিত আছে। এর মধ্যে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

২০১৫ সালের ২৩ মে থেকে এ হার কার্যকর রয়েছে। তার আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি।

এ বিভাগের আরো খবর