চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় গতবারের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারও বেড়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সোমবার নিয়মিত বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ ইউএস ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২ হাজার ৬৪ ডলার।
এ ছাড়া চলতি মূল্যে এবার জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ৪৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা গতবার ছিল ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।
জিডিপির হার কত হবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি সরকার এখনও। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে জিডিপির হার হতে পারে ৬ দশমিক ১ শতাংশ কিংবা তার চেয়ে একটু বেশি।
এনইসিতে মঙ্গলবার নতুন এডিপি অনুমোদন পাওয়ার পর সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত সেটিই সঠিক।
এদিকে করোনা মহামারির মধ্যে বাংলাদেশ অন্য দেশগুলোর চেয়ে প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ে ভালো করেছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলেছেন, নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও গতবারের তুলনায় এ বছর ভালো করেছে বাংলাদেশ। তবে প্রবৃদ্ধি কত হবে, সেই বিতর্ক না করে এখন সরকারের উচিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের দিকে মনোযোগ দেয়া।
তাদের মতে, করোনাকালে সরকার যেসব প্রণোদনা দিয়েছে, তার সুফল সবাই পায়নি কিংবা সমভাবে বণ্টিত হয়নি। এ কারণে অর্থনীতিতে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। আর বৈষম্য যদি বাড়তেই থাকে, তাহলে প্রবৃদ্ধির সুফল পাবে না সাধারণ জনগণ।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। যদিও বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আইএমএফ এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছে।
২০২০ সালের মার্চে দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পর টানা দুই মাসের বেশি লকডাউন থাকে। এর পর ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চাকা সচল হতে থাকে।
সরকারের প্রত্যাশা ছিল চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই আগের চেহারায় ফিরে যাবে অর্থনীতি। সে লক্ষ্য সামনে রেখে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয় ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান হওয়ায় সরকারের প্রত্যাশা ছিল জিডিপি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছাবে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়।
এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি হতে পারে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাদের এ পূর্বাভাস গ্রহণ করেননি। এর চেয়ে বেশি প্রত্যাশা করেন তিনি।
কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিডিপি কতটা কার্যকর, তা নিয়ে ইদানীং প্রশ্ন উঠেছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়লেই দেশের উন্নয়নের জোয়ার বইবে, তা বলা যাবে না। সাধারণ জনগণের জীবনমানের উন্নতি কতটুকু হয়েছে, তা দেখতে হবে।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশ তুলনীয় দেশগুলোর চেয়ে প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ে ভালো করছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ কি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে ভালো করছে? যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে? ‘পুঁজিবাজারে ভালো করেছে? গরিব মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যে ভালো করেছে কি? এ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে।’
তিনি মনে করেন, ‘সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ গত কয়েক বছর ধরে একই জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। এই বলয়ের বৃত্ত থেকে আমরা বের হতে পারছি না।
‘কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে আমাদের বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে।’
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘আমাদের ধারণা ছিল, ব্যবসার ব্যয় কমালে বা সুদের হার কমালে ব্যক্তি খাত উৎসাহিত হবে। পুঁজিবাজারে প্রণোদনা দিলে ভালো বিনিয়োগ আসবে। কিন্তু তা হয়নি।’
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ও বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘করোনার মধ্যে দেশের অর্থনীতি ভালো করেছে। ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়ায় মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে।’
তিনি মনে করেন, অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তাহলে প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ জনগণ পাবে।
সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘করোনায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যেসব প্রণোদনা দিয়েছে সরকার, তার সুবিধা সবাই পায়নি। ‘বড় ব্যবসায়ীরা ছোটদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সুবিধা পেয়েছে। এতে করে অর্থনীতিতে একধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি মনে করেন, প্রবৃদ্ধির বিতর্কে না গিয়ে সরকারের উচিত হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া। তাহলে বৈষম্য কমবে; সাধারণ জনগণ উপকৃত হবে।