ঈদের ছুটির আগে পুঁজিবাজারের আচরণ নিয়ে বাজার বিশ্লেষকদের মধ্যে আশাবাদ দেখা দিয়েছিল, তার প্রতিফলন দেখা গেল ঈদ শেষে প্রথম কর্মদিবসে।
ব্যাংক, বস্ত্র, ওষুধ ও রসায়ন ও আরও নানা খাতে দর বৃদ্ধির প্রবণতায় সূচকে উত্থান হয়েছে। ব্রোকারেজ হাউজে বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি কম থাকলেও লেনদেন দেড় হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হয়েছে।
প্রতি বছর ঈদের আগে টাকা তোলার প্রবণতায় বাজারে দর পতন একটি স্বাভাবিক চিত্র। এবার লকডাউন নিয়ে ছিল আতঙ্কও। তবে এবার সেই চিত্র ছিল না বাজারে। সূচকের পাশাপাশি বেড়েছে লেনদেনও।
ছুটির আগে ব্যাংক ও বস্ত্র খাতের সুদিনের আভাস দিয়ে ঈদের ছুটিতে গিয়েছিল পুঁজিবাজার। ছুটি শেষে প্রথম কার্যদিবস রোববারও বেশি চাঙ্গাভাব মূলত এই দুই খাতেই। বেড়েছে প্রায় সবকটি ব্যাংক ও বস্ত্র কোম্পানির শেয়ার মূল্যও। তবে লকডাউনের পর থেকে টানা বাড়তে থাকা বিমা খাতে দেখা গেছে ভাটার টান।
লেনদেনে ব্যাংক খাতে তালিকাভুক্ত ৩১টি ব্যাংকের মধ্যে রোববার দর কমেছে মাত্র একটির। পাল্টায়নি পাঁচটির। বাকি ২৫ ব্যাংকের শেয়ার দর বেড়েছে।
বস্ত্র খাতের উত্থান ছিল সবচেয়ে বেশি। এ খাতের তালিকাভুক্ত ৫৬টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৪৬টির। কমেছে আটটির। দর পাল্টায়নি দুটির।
টানা দর বাড়তে থাকা বিমা খাতের শেয়ার দর কমেছে বেশির ভাগ কোম্পানির। এদিন লেনদেনে থাকা ৫০টি কোম্পানির মধ্যে দর কমেছে ৩৩টির। দর পাল্টায়নি চারটির। দর বেড়েছে ১৩টি কোম্পানির।
সকাল ১০টায় লেনদেনের শুরুতে পাঁচ মিনিটে সূচক বাড়ে ৩০ পয়েন্টে। তারপর ২২ মিনিটের শেয়ার বিক্রির চাপে ধাক্কা লাগে সূচকে। কমে আসে ১৬ পয়েন্ট। তবে এরপর আর কমেনি, সূচক শুধুই বেড়েছে, যা লেনদেন শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
দিন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে ৬২ পয়েন্ট। লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ২৩১টির। কমেছে ৮৮টির। দর পাল্টায়নি ৪৯টির।
সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধিতে বস্ত্র খাত
দিনের সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধি পাওয়া চারটি কোম্পানির মধ্যে দুটি ছিল বস্ত্র খাতের। একটি ছিল প্রকৌশল খাতের, আরেকটি ছিল ওষুধ ও রাসায়ন খাতের।
বস্ত্র খাতের দুটি কোম্পানির মধ্যে নূরানী ডাইং অ্যান্ড সোয়েটার লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ১০ শতাংশ। এবং জেড ক্যাটাগরির কোম্পানি তুং হাই নিটিং কোম্পানির শেয়ার দরও বেড়েছে দিনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ।
জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সায়হাম টেক্সটাইল মিলসের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। রিং সাইন টেক্সটাইল লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
ডেল্টা স্পিনিংয়ের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ। হামিদ ফেব্রিকসের শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
আলিফ ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।
ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার বলেন, ‘বস্ত্র খাতের প্রতি আগ্রহের কারণ কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ দেয়ার সময় চলে এসেছে। বেশিরভাগ কোম্পানির অর্থবছর শেষে হচ্ছে জুন মাসে। এছাড়া এ খাতের অনেক কোম্পানির শেয়ার দর এখন অনেক কম।
ব্যাংকের কী চিত্র
টানা ছয় দিন দিনের সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধি পেয়েছে এনআরবিসি ব্যাংকের। এদিন ব্যাংকটির শেয়ার দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ১৯ টাকা ৬০ পয়সা নিয়ে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার পর প্রথম কর্মদিবসে দাম দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা ৫০ পয়সা।
চলতি বছর প্রথম প্রান্তিতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তিন গুণ মুনাফা করা প্রাইম ব্যাংকের শেয়ার দর বেড়েছে ১ টাকা ৮০ পয়সা। মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের বেড়েছে ১ টাকা ৭০ পয়সা।
এ ছাড়া আইএফআইসি ও ইউসিবির ৭০ পয়সা করে, এনবিএলের ৬০ পয়সা, ব্র্যাক, সিটি ও ডাচ বাংলার দাম বেড়েছে ৫০ পয়সা করে। বাকি সবগুলোর দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৩০ পয়সা।
ব্যাংকের মতো উত্থান দেখা গেছে আর্থিক খাতেও। এই খাতের ২৩টি কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ১৬টির। কমেছে কেবল দুটির। একটির লেনদেন স্থগিত কয়েক মাস ধরে। বাকি চারটির দর অপরিবর্তিত ছিল।
এই খাতের কোম্পানির মধ্যে টাকার অংকে সবচেয়ে বেড়েছে আইসিবির শেয়ার। ৭ টাকা ২০ পয়সা বা ৭.৪৪ শতাংশ বেড়ে এখন দাম দাঁড়িয়েছে ১০৪ টাকা।
শতকরা হিসেবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ন্যাশনাল হাউজিং ফিনান্সের দর। ৮.১৩ বা তিন টাকা বেড়ে এই কোম্পানির শেয়ার দর দাঁড়িয়েছে ৩৯ টাকা ৯০ পয়সা।
৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতেও গেল আরও একটি ভালো দিন। ৩৭টি ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২৩টির। কমেছে মাত্র পাঁচটির দাম। বাকি নয়টির দাম ছিল অপরিবর্তিত।
এখন বিমার পড়তি সময়
৫ এপ্রিল লকডাউন শুরুর পর থেকে কেবল বিমা খাতে ভর করেই এগিয়েছে পুঁজিবাজার। শেয়ারের দাম দেড় থেকে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে এক মাসে।
তবে ঈদের আগে আগে এই খাতে দেখা দেয় পতন। মাঝে একদিন উত্থান ছাড়া বাজার পড়েছে পাঁচ দিন। ঈদ শেষেও একই প্রবণতা দেখা গেল।
সবচেয়ে বেশি দর পতন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে ছিল মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স, যার শেয়ার দর কমেছে ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
এরপরেই ছিল যথাক্রমে ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, যার শেয়ার দর কমেছে ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এছাড়া সোনারবাংলা ইন্স্যুরেন্স, সন্ধানী ইন্স্যুরেন্স, প্রভাতি ইন্স্যুরেন্স, ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ২ শতাংশ পর্যন্ত।
অন্যান্য খাতে যে প্রবণতা
লকডাউনের পর থেকে প্রথমে বিমা, পরে মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এরপর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর শেষে বস্ত্র খাতে উত্থানের পরও আরও বেশ কিছু খাত ছিল ঘুমিয়েই।
ঈদের ছুটি শেষে বড় খাতগুলোর মধ্যে প্রকৌশলের কোম্পানিগুলোর প্রতিও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখা গেল।
এই খাতের ৪২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ২৮টির। সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি হয়েছে যেসব কোম্পানির, তার মধ্যে আছে প্রকৌশল খাতের সুহৃদ ও বিডি ওয়েল্ডিং। দুটির দরই বেড়েছে একদিনে যত বাড়া সম্ভব ততই।
খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের ২০টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১৪টির। এই বাতে শতকরা হিসেবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ফাইন ফুডের দর। শেয়ার প্রতি তিন টাকা ২০ পয়সা বা ৬.৯৬ শতাংশ বেড়েছে এই কোম্পানির দর।
তথ্য প্রযুক্তি খাতের ১১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে নয়টির। সবচেয়ে বেশি দুই টাকা বেড়েছে আমার নেটের দর।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ২২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১৬টির। কমেছে পাঁচটির। আর পাল্টায়নি একদিন দর।
ওষুধ ও রসায়ন খাতের ৩১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ২০টির। কমেছে পাঁচটির। আর পাল্টায়নি বাকি ছয়টির দর।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৬২ দশমিক ৬৬ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮১৩ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৪ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৮২ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৮ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৯২ পয়েন্টে।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই বেড়েছে ১৯৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮৫৭ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ১৮৬টির, কমেছে ৭১টির। পাল্টায়নি ৩২টির। মোট লেনদেন হয়েছে ৬৩ কোটি টাকা।