করোনার আগে প্রতি বছরই রোজায় মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার। সরকারি সংস্থাগুলোও ব্যবসায়ীদের সেই বেঁধে দেয়া দর মেনে চলতে নিয়মিত বাজার তদারকি করত। কিন্তু এ বছর তা করা হয়নি।
এ অবস্থায় ঈদের আগে নিয়ন্ত্রণহীন মাংসের বাজার। মঙ্গলবার রাজধানীর একেক বাজারে একেক দামে মাংস বিক্রি করতে দেখা গেছে। এদিন প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬০০-৬২০ টাকায় এবং খাসির মাংস ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে মঙ্গলবার রাজধানীতে গরুর মাংস ৫৬০-৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫৫০-৫৮০ টাকা। খাসির মাংস আগের মতোই ৮০০-৯০০ টাকা রয়েছে।
করোনার কারণে গতবারের মতো এবারও মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেয়নি সরকার। তাই দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো সংস্থাও কাজ করছে না। ফলে একেক এলাকার ব্যবসায়ীরা একেক দামে মাংস বিক্রি করছেন। বাজার ও এলাকাভেদে পার্থক্য ৫০-১০০ টাকা।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে অনেকেই কৃষিতে যুক্ত হয়েছেন। নতুন নতুন খামার হয়েছে। এসব খামারে গরু-ছাগল পালন করা হচ্ছে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে। তাই বাজারে গরুর সরবরাহ কিছুটা কম। এটাও মাংসের দাম বাড়ার বড় কারণ।
তারা বলছেন, গতবারের মতো এবারও সরকার বা সিটি করপোরেশন থেকে মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। দিলে তারা সে দামেই বিক্রি করতেন। তারা পাইকারদের কাছ থেকেই গরু কিনে থাকেন। দাম বেশি পড়লে, বিক্রিও করেন বেশি দামে। এবার প্রায় পুরো রমজান মাসেই দাম স্থির ছিল। তবে দুই-তিন দিন ধরে দাম কিছুটা বাড়তি। নির্ধারিত না থাকায় বাজারভেদে দামের তারতম্য রয়েছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর বিজয় সরণি বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬২০ টাকায় এবং খাসির মাংস ৮৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬০০ টাকায় এবং খাসির মাংস ৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
কারওয়ান বাজারের মাংস বিক্রেতা আবদুল কুদ্দুস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাটে গরু-খাসির একেক দিন একেক দাম থাকে। যে বেশি দামে কিনছে, সে বেশি দামে বেচতাছে। তবে দাম বাড়লে আমাগেই ক্ষতি। বেশি দামে কাস্টমার কেনে কম। লাভও কম। দাম কম হলেই ভালো।’
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল ইসলাম দাম বাড়ার কারণ হিসেবে সিটি করপোরেশনের হাটে অব্যবস্থাপনা, দাম বেঁধে না দেয়া এবং নজরদারি ও সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করেছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর সরকার মাংসের দাম বেঁধে দেয়। কিন্তু এবার দেয়নি। তাই ব্যবসায়ীরাও যে যারমতো দামে বিক্রি করছে। তাদের কিছু বলাও যাচ্ছে না, তাদের নিয়ন্ত্রণ করাও যাচ্ছে না। কারণ, নির্দিষ্ট কোনো দাম নেই। অথচ মাংসের এমন দাম হওয়া উচিত নয়। এ খাতে পরিকল্পিতভাবে নজর দিলে গরুর মাংস ৩০০-৩৫০ টাকায় এবং খাসির মাংস ৫০০ টাকার কমে খাওয়ানো সম্ভব।’
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল প্রশ্ন রেখে বলেন, কার স্বার্থে সিটি করপোরেশন এবার দাম নির্ধারণ করল না? ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন দাম নির্ধারণ করা নিয়ে বৈঠকও ডেকেছিল। এক দিন বৈঠক হলো। আর খবর নেই। দক্ষিণ সিটিতেও একই অবস্থা। দাম নিয়ে দুই সিটির কারোরই কোনো নজরদারি নেই। ইচ্ছেমতো দাম রাখছেন ব্যবসায়ীরা।
বাড়তি খাজনা ও পথে পথে চাঁদাবাজিও মাংসের দাম বাড়ার কারণ বলে তিনি অভিযোগ করেন। বলেন, ‘হাটে বাড়তি খাজনা আদায় হয়, গরু-ছাগলের ট্রাকে জায়গায়-জায়গায় টাকা দিতে হয়। দাম বাড়বে না তো কী? এসব বন্ধ হোক। দেশে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। চরের খালি জায়গা পশু পালনে দেয়া হোক। মাংস আমদানি বন্ধ হোক। দাম অর্ধেকে নামবে।’
খামারিরা বলছেন, পশুর খাবারের বাড়তি দামের কারণেও মাংসের দাম বাড়ছে। বর্তমানে কেজি প্রতি গরুর মাংস উৎপাদনে খরচ হয় ৩৫০-৩৮০ টাকা। খাসির মাংসে খরচ পড়ে ৫০০ টাকার মতো। তাই গরুর মাংস ৪৫০ টাকা এবং খাসির মাংস ৬০০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু খামারের গরু দুই হাত হয়ে বিক্রি হয়; এতে কেজিতে বাড়তি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা গুনতে হয় ক্রেতাদের।
ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, করোনার কারণে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় গত কোরবানিতে মানুষ গরুর পরিবর্তে ছাগলের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাই এবার গরুর পাশাপাশি প্রচুর ছাগল কোরবানির জন্য লালনপালন করা হচ্ছে। এ কারণে বাজারে সরবরাহও কমেছে।
মাংসের দাম কোন বছর কত ছিল
সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে মাংসের দাম বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগও রেয়েছে। ২০১৩ সালের রোজার আগে দেশে এক কেজি গরুর মাংস ছিল ২৫০ টাকা। পরে মাংস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে সিটি করপোরেশন দাম বাড়িয়ে করে ২৭৫ টাকা। সেই দাম আর কমেনি, এক বছর একই দাম ছিল।
২০১৪ সালের রমজানে তা ২৮০ টাকা এবং ২০১৫ সালে ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
পরের বছর সীমান্ত দিয়ে গরু না আসার অজুহাত দিয়ে দাম বাড়িয়ে করা হয় ৩৭০ টাকা। ২০১৭ সালের রমজান মাসে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করা হয় ৪২০ টাকা। একই অজুহাতে ২০১৭ সালে দাম বাড়িয়ে করা হয় ৪৪০ টাকা, সবশেষ ২০১৮ সালের রমজানে দাম নির্ধারণ করা হয় ৫০০ টাকা।
২০১৯ সালে রোজার আগে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৫২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
খাসির মাংসের দাম ২০১৫ সালেও ছিল ৫০০ টাকার মধ্যে। ২০১৬ সালের রোজায় তা সিটি করপোরেশন বাড়িয়ে করে ৫৭০ টাকা। সে দামই ২০১৯ সালে নির্ধারণ করা হয় ৭৫০ টাকা। এর পরে শুধুই দাম বেড়েছে।