দেশে এখন ধান কাটার উৎসব চলছে। চলতি মৌসুমে বোরো ধান কাটার এই উৎসব শুরু হয়েছে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে। বোরো আবাদের তীর্থস্থান সুনামগঞ্জ। জেলার সব কটি হাওরে উৎপাদিত ধান এখন গোলায় উঠছে।
কৃষিমন্ত্রী স্বশরীরে উপস্থিত থেকে হাওরে ধান কাটার এই উৎসব উদ্বোধন করেন। সেখানে ব্রি-২৮ জাতের ধানের পাশাপাশি কাটা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের হাইব্রিড ধান। নেত্রকোণার হাওর এবং মুন্সিগঞ্জের আড়িয়ল বিলের ধানও কৃষকের ঘরে উঠতে শুরু করেছে। সারা দেশে গ্রামে গ্রামে ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে।
তবে ধান ওঠার এই মৌসুমেও চলছে চালের আমদানি। সরকারি-বেসরকারি দুইভাবেই আমদানি হচ্ছে চাল। দেয়া হচ্ছে নতুন আমদানির অনুমোদনও। শুধু বেসরকারিভাবে দৈনিক ১০ হাজার ৮৭০ টন করে চাল আমদানি হচ্ছে।
আমদানির কারণে কৃষকরা ধানের প্রত্যাশিত দাম হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কৃষকরা বলছেন, যখন চাল আমদানির প্রয়োজন ছিল, তখন আমদানি করা হয়নি। দেশে চালের সরবরাহ পরিস্থিতিতে সংকট তৈরি হওয়া সত্ত্বেও সরকার চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে দেরিতে। তখন অনুমতি পাওয়া আমদানিকরা চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছেন আরও দেরিতে।
আবার, সরকার যে পরিমাণ আমদানির অনুমোদন দিয়েছে, সেই তুলনায় দেশে চাল ঢুকেছে কম। ফলে চালের বাজারে উত্তাপ এখনও কমেনি। এখন যেই মাঠের ধান গোলায় উঠছে, চালের আমদানি গেছে বেড়ে।
ধান ওঠার মৌসুমে কেন বিদেশ থেকে চাল আমদানি হচ্ছে, জানতে চাইলে খাদ্যসচিব ড. নাজমানারা খানুম এ প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে বলেন, চাল আমদানি অব্যাহত থাকবে, তবে বেসরকারি পর্যায়ে নয়। কাউকে এখন বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না সরকার।
তিনি জানান, যে চাল এখন আমদানি হচ্ছে বা হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, সেই চাল উঠবে সরকারের গুদামে। করোনা পরিস্থিতিসহ দেশে আপৎকালীন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি সম্প্রসারণ ও জোরদার করতেই এই চাল আমদানি হচ্ছে। শুধু আমদানির মাধ্যমেই নয়, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমেও সরকারের মজুত সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ রয়েছে।
এর আগে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, যারা চাল আমদানির অনুমোদন নিয়েও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চালের এলসি খোলেননি, তাদের আমদানি অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। তবে যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এলসি খুলেছেন, সক্ষমতা বুঝে তাদের অনুকূলে বাতিলকৃত বরাদ্দ পুনর্বণ্টন করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেসরকারিভাবে আমদানি অনুমোদন পাওয়া চাল এত দিন ধীরগতিতে এলেও দেশে ধানের ফলন ওঠার মৌসুমে আমদানি চাল প্রবেশের গতি বেড়েছে। ফ্রেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে বেসরকারি আমদানি চালের পরিমাণ দেড় লাখ টনের মধ্যে থাকলেও শেষ সোয়া দুই মাসে তা প্রায় সাড়ে সাত লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চাল আমদানি পরিস্থিতির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে বেসরকারি পর্যায়ে দৈনিক ১০ হাজার ৮৭০ টন হারে মোট ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩০ টন চাল আমদানি হয়েছে।
বেসরকারিভাবে সরকার মোট ৩২০ জন আমদানিকারককে ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয়। কিন্তু অনুমতিপ্রাপ্তরা এলসি খোলার সময়সীমা দুইবার বাড়ানোর সুযোগ পেয়েও ফেব্রুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত অনেকে এলসি খোলেননি। আবার যারা খুলেছেন, তাদের অনেকে চাল আমদানি করেননি। কেউ কেউ করলেও পরিমাণ প্রত্যাশিত ছিল না।
অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানাচ্ছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯০০ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর বিপরীতে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার ৩৬৬ হেক্টর জমি থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন পাওয়া গেছে ৩ দশমিক ২৯ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে, চলতি বোরো মৌসুমে দেশে ধানের জমিতে কয়েক ঘণ্টার হিট শক বয়ে গেছে। এতে ২১ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। তবে আশার খবর হচ্ছে, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭৮ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ধানের অর্জিত ফলন প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে ধানের সার্বিক উৎপাদন এবার গতবারের তুলনায় না কমে উল্টো লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। সামনে প্রকৃতি খারাপ থাকলেও সেটি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিই থাকবে।
এ পরিস্থিতিতে কৃষকের ধানের দাম পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই জানিয়ে খাদ্যসচিব ড. নাজমানারা খানুম আরও বলেন, ইতিমধ্যে সরকার দেশে ধান-চালে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে।
সরকার চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে ৬ লাখ টন ধান এবং সাড়ে ১১ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ও কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ঘোষণা অনুযায়ী, সরকার কৃষকের কাছ থেকে কেজিপ্রতি ২৭ টাকা দরে ধান কিনবে, আর কেজিপ্রতি ৪০ টাকা দরে ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং ৩৮ টাকা দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল কিনবে চালকল মালিকদের কাছ থেকে। এই দাম গত বছরের তুলনায় কেজিপ্রতি যথাক্রমে এক টাকা ও তিন টাকা বাড়ানো হয়েছে।
গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান কেনা শুরু হয়েছে। চাল সংগ্রহের অভিযান শুরু হয়ে গেছে ৭ মে থেকে। চলবে আগামী আগস্ট মাস পর্যন্ত।