পুঁজিবাজারে খাত ধরে উত্থানের যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তাতে এবার যোগ হয়েছে বস্ত্র খাত। এক দিনে এই খাতের প্রায় সব শেয়ারের দর বৃদ্ধির ঘটনা ঘটল।
এর আগে টানা এক মাস বিমা খাত, পরে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে একাধিক দিন এই চিত্র দেখা গেছে। মাঝে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের শেয়ারগুলোর দরও দল বেঁধে বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে।
রোববার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বস্ত্র খাতে তালিকাভুক্ত ৫৬টি কোম্পানির মধ্যে পাঁচ দিন দাম কমার বিপরীতে বেড়েছে ৪৩টির দর। বাকি ৮টি কোম্পানির দর ছিল অপরিবর্তিত।
২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ার পর এক বছরের বেশি সময় ধরেই এই খাতের শেয়ারগুলো নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। বহু শেয়ার লেনদেন হচ্ছে অভিহিত মূল্যের নিচে বা আশপাশে। এই অবস্থায় এই খাতের শেয়ারগুলোর মধ্যে বেশ কিছু বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয়ও হয়ে গেছে।
আবার করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়ার যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, বেশির ভাগ কোম্পানির ক্ষেত্রেই তা সত্য প্রমাণ হয়নি। পুঁজিবাজারে যেসব কোম্পানি প্রান্তিক প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে অনেক কোম্পানির আয়ই কমার বদলে বেড়েছে।
বস্ত্রের মতো অত ভালো না করলেও ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের বেশির ভাগ কোম্পানিই দর ধরে রাখতে পেরেছে। বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারদরও বেড়েছে।
বড় মূলধনি খাতে দর বাড়ার প্রভাবে পুঁজিবাজারে সূচক বেড়েছে ৩৯ পয়েন্ট। শেয়ার কেনায় বিনিয়োগকারীদের যে আগ্রহ বেড়েছে, সেটি লেনদেনের চিত্রই বলে দেয়। টানা ৯ দিন এক হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হলো ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে।
চাঙা বাজারে আগের দুই কার্যদিবসের ধারাবাহিকতায় বড় পতন দেখল বিমা খাত।
গত এক মাসে বিমা খাতের প্রায় সবকটি কোম্পানির ন্যূনতম ৫০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত দর বেড়েছে। দর বাড়ছে দেখে যারা বিমা খাতের শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন কিংবা আরও দাম বাড়বে ভেবে ধরে রেখেছেন তারা গত দুই দিনে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৮ টাকা শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছেন।
রোববার সবচেয়ে বেশি দরপতন হওয়া শেয়ারগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোই বিমা খাতের।
সর্বাধিক দর বৃদ্ধি তালিকার প্রায় বস্ত্র খাতের আধিক্য
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া ১০টি কোম্পানির ৫টি এবং ২০টি কোম্পানির ১১টিই ছিল বস্ত্র খাতের। গত এক বছরে এই চিত্র দেখা যায়নি।
সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে সিমটেক্সের দর। ১০ শতাংশ বেড়ে ১৪ টাকার শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ১৫ টাকা ৩০ পয়সায়।
ভিএফএস থ্রেড ডাইং কোম্পানির, যার শেয়ারপ্রতি দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ১ টাকা ৮০ পয়সা বেড়ে এখন লেনদেন হচ্ছে ২০ টাকা ৩০ পয়সা।
লোকসানি কোম্পানি তাল্লু স্পিনিং এর দামও বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই। ৪ টাকা ১০ পয়সার শেয়ার আজ লেনদেন শেষ করেছে ৪ টাকা ৫০ পয়সায়।
প্রাইম টেক্স স্পিনিং মিলস লিমিটেডের শেয়ারদরও বেড়েছে ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এদিন কোম্পানিটির শেয়ারদর ১৫ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭ টাকা ২০ পয়সা।
মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিলসের শেয়ারদর বেড়েছে ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ। শেয়ারদর ১৬ টাকা ২০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭ টাকা ৪০ পয়সা।
এইচ আর টেক্সটাইলের শেয়ারপ্রতি দর বেড়েছে ১ টাকা ১০ পয়সা। এনভয় টেক্সটাইলের শেয়ারদর বেড়েছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ বা ১ টাকা ৭০ পয়সা। লেনদেন হয়েছে ২৩ টাকা থেকে ২৪ টাকা ৬০ পয়সায়।
ডিএসইতে সবশেষ লেনদেনের চিত্র
বাড়তি দরে স্থিতিশীল ব্যাংক ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড
গত বুধবার এই দুই খাতের প্রায় সব কোম্পানির দর বেড়েছে। পরের কার্যদিবসে বাড়ে আরও কিছু কোম্পানির শেয়ারদর। তবে কমেও কিছু কোম্পানির।
আজ ব্যাংক খাতের ৩১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১৫টির। কমেছে ৯টির। পাল্টায়নি ৭টির।
সর্বাধিক দর বৃদ্ধির তালিকায় গত তিন কার্যদিবস ধরেই আছে নতুন তালিকাভুক্ত এনআরবিসি। ১৪ টাকা ৯০ পয়সা থেকে এক টাকা ৪০ পয়সা বেড়ে শেয়ারদর এখন দাঁড়িয়েছে ১৬ টাকা ৩০ পয়সা। এক দিনে এর চেয়ে বেশি বাড়া সম্ভব ছিল না।
টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ব্র্যাক ব্যংকের শেয়ারদর। আগের দিনের দরের সঙ্গে যোগ হয়েছে দুই টাকা। এ ছাড়া প্রাইম ব্যাংকের ৬০ পয়সা আর ইউসিবিএলের ৫০ পয়সা বেড়েছে।
সবচেয়ে বেশি কমেছে রূপালী ব্যাংকের দর। আগের দিনের চেয়ে ৫০ পয়সা কমে লেনদেন হয়েছে এই ব্যাংকের শেয়ারদর। এরপর সবচেয়ে বেশি ৩০ পয়সা দর হারিয়েছে ইবিএল। দর হারানো বাকি ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর ১০ থেকে ২০ পয়সা কমেছে।
ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের ২৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর বেড়েছে ১০টির। কমেছে ৮টির। দর পাল্টায়নি ৫টির।
মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৬টির। কমেছে ১৫টির। দর পাল্টায়নি ৬টির।
বিমার দরে ধস
রোববার লেনদেন শেষে যে ১২টি কোম্পানির শেয়ারদর সবচেয়ে বেশি কমেছে তার মধ্যে সবকটিই বিমার। এদিন লেনদেনে ৫০টি বিমা কোম্পানির মধ্যে মাত্র তিনটি কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে। দুটির দর পাল্টায়নি। বাকি ৪৫টি কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে।
অগ্রণী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। লেনদেনে ৬৫ টাকা ৭০ পয়সা থেকে দর কমেছে হয়েছে ৫৯ টাকা ২০ পয়সা।
ইউনাইটেডে ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। শেয়ার দর ৫৬ টাকা ৭০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৫১ টাকা ৬০ পয়সা।
তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৮ দশমিক ৭০ শতাশং। শেয়ার দর ৫৮ টাকা ৬০ পয়সা থেকে হয়েছে ৫৩ টাকা ৫০ পয়সা।
ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৬০ টাকা ৭০ পয়সা। শেয়ার দর ৬০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৫৫ টাকা ৬০ পয়সা।
পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ। লেনদেনে ২৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ২৪ টাকা ২০ পয়সা।
সন্ধানী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। শেয়ার দর ৩১ টাকা ১০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ২৯ টাকা ৮০ পয়সা।
কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর ৫৩ টাকা ১০ পয়সা থেকে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ কমে হয়েছে ৪৯ টাকা ৫০ পয়সা।
মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর ৪৪ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ কমে হয়েছে ৪১ টাকা ৯০ পয়সা।
নিটল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। শেয়ার দর ৬০ টাকা ৩০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৫৬ টাকা ৩০ পয়সা।
কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। শেয়ার দর ৪২ দশমিক ৬০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৩৯ টাকা ৯০ পয়সা।
ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ কমে ৫২ টাকা ৫০ পয়সার শেয়ার দিন শেষে হয়েছে ৪৯ টাকা ৪০ পয়সা।
নর্দান জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দরও কমেছে ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ।
বিশ্লেষকের বক্তব্য
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার বলেন, ‘বিমা খাতের শেয়ারের যে দর পতন হয়েছে সেটি প্রত্যাশিত ছিল। এরপর দর পতন বা মূল্য সংশোধন না হলে বড় ধনের ঝুকিতে পড়তে হতো বিনিয়োগকারীদের।’
তিনি বলেন, ‘এক খাতের দর পতন হলে অন্য খাতের শেয়ারের দর বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে কোনো খাতেরই অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি ও পতন পুঁজিবাজারের জন্য ভালো না। খাতওয়ারি মোটামুটি সবগুলোই বাড়ছে, এটা ভালো লক্ষণ।’
তিনি বলেন, ‘ঈদের আর কয়েক দিন বাকি আছে। এখন বিনিয়োগকারীরা লাভে থাকা শেয়ার বিক্রি করে টাকা উঠাবে।’
সূচক ও লেনদেন
এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৬৭ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৪৫ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ৯ দশমিক ৩০ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬১ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ২৮ দশমিক ৭১ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৬৫ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ১৭৬টির, কমেছে ১২৮টির। পাল্টায়নি ৬৩টির।
লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাস স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই ১২২ দশমিক ২৮ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৩৩১ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ১৪১টির। কমেছে ৯৬টির। দর পাল্টায়নি ৩৭টির। লেনদেন হয়েছে মোট ৬৬ কোটি টাকার।