নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারদর আগের মতো প্রথম দুই কার্যদিবসে ৫০ শতাংশ করে বাড়তে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মিশ্র পর্যবেক্ষণ দেখা গেছে। সিদ্ধান্তের ফলে কেবল আইপিও করেন যারা তাদের কাজ কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছে একটি অংশ। তারা মনে করছে, এ সিদ্ধান্তে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ বাড়বে।
তবে অপর অংশের মত, নতুন সিদ্ধান্তে বাজারে অর্থপ্রবাহ কমবে।
দেশে এখন ২৬ লাখ বিও হিসাব থাকলেও নিয়মিত লেনদেন হয় এমন বিও হিসাব আট থেকে ১০ লাখের মতো। বাকি বিও হিসাব কেবল আইপিও আবেদনে ব্যবহার হয়। কিন্তু আইপিও আবেদন করতে গিয়ে এসব হিসাবে মাসের পর মাস বিপুল অঙ্কের টাকা আটকে থাকে। আইপিও আকর্ষণ হারালে সেই টাকা এখন সেকেন্ডারি মার্কেটে চলে আসবে বলে ধারণা করছেন কেউ কেউ।
বিপরীত চিন্তার অনেকে বলছেন, আইপিওতে সবার জন্য শেয়ার নিশ্চিত করার পদ্ধতি চালু হলে বাজারে অর্থপ্রবাহ কমবে। কারণ এখন আইপিও আবেদন করতে হলে সেকেন্ডারি মার্কেটে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ লাগবে। আইপিও আকর্ষণ হারালে এই বিও হিসাবগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাজারে তারল্য কমে যাবে।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকেই নতুন কোম্পানির শেয়ার আনুপাতিক হারে বণ্টন হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত করোনা পরিস্থিতির কারণে এ সময়ে নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্ত না হওয়ায় শেয়ার বণ্টনের নতুন নিয়ম কার্যকর হয়নি।
মে মাসের শেষের দিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে আইপিও আবেদন নেবে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। আবেদনকারীদের সবাই এই কোম্পানির শেয়ার পাবেন। আনুপাতিক হারে তাদের মধ্যে শেয়ার বণ্টন করা হবে। তবে আইপিওতে শেয়ার পেলেও কাঙ্ক্ষিত দাম পেতে বিনিয়োগকারীদের অনেক বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে।
২০১৯ সালের নভেম্বরের আগে প্রথম কার্যদিবসে নতুন শেয়ারের কোনো মূল্যসীমা থাকত না। এমনও দেখা গেছে, অভিহিত মূল্যের ১৬ গুণ দামে বিক্রি হয়েছে শেয়ার। পরে দর কমে আসায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন শেয়ারধারীরা।
তবে গত দেড় বছর ধরে প্রথম দুই কার্যদিবসে দাম বাড়তে পেরেছে ৫০ শতাংশ করে। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে তালিকাভুক্ত শেয়ার প্রথম দিন ১৫ টাকা ও দ্বিতীয় দিন ২২ টাকা ৫০ পয়সা হয়ে দ্বিগুণ হতে পেরেছে।
গত এক বছরে এনআরবিসি ব্যাংক ছাড়া সব কোম্পানির শেয়ারদরই এভাবে দুই দিনেই ২২ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে। ফলে আইপিওর দ্বিগুণ টাকা আয় করতে শেয়ারধারীদের অপেক্ষা করতে হয়নি বললেই চলে।
কেবল ১০ টাকা মূল্যে নয়, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৩১ টাকায় তালিকাভুক্ত এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশনের শেয়ার দরও প্রথম দুই কার্যদিবসে বেড়েছে ৫০ শতাংশ করে।
৫৪ টাকায় তালিকাভুক্ত মীর আকতার হোসেন কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার প্রথম দিনে ৫০ শতাংশ এবং দ্বিতীয় দিনে আরও প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে এক পর্যায়ে ১১৭ টাকায় উঠে যায়।
তবে নতুন নিয়মে এখন থেকে ১০ টাকার শেয়ার ২২ টাকা ৫০ পয়সা হতে হলে নয়টি কার্যদিবস অপেক্ষা করতে হবে এবং প্রতিদিনই সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হতে হবে শেয়ারটির। তবে টানা নয় কার্যদিবস কোনো শেয়ারের হলট্রেড হওয়ার ঘটনা বিরল।
সম্প্রতি কেবল রবির শেয়ার ১৪ কার্যদিবস বেড়েছিল সর্বোচ্চ পরিমাণে। তবে বেড়ে যে টাকা হয়েছিল, এখন দাম তার ৬০ শতাংশের মতো।
নতুন সিদ্ধান্তের ফলে শুধু আইপিও আবেদনকারীরা হতোদ্যম হতে পারেন। আর সে ক্ষেত্রে তারা ২০ হাজার টাকা সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ করবেন কি না, সে প্রশ্ন থেকে যায়।
কী বলছেন বিশ্লেষকরা
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে যেভাবে শেয়ারের দর বাড়াত তাতে দ্রুতই শেয়ারের দর দ্বিগুণ-তিন গুণ হয়ে যাচ্ছিল। এতে অনেকের কারসাজি করে শেয়ার ধরে রেখে দর বাড়ানোর প্রবণতা ছিল। তাই আমরা নতুন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন কারসাজি করে দ্রুততার সঙ্গে শেয়ারের দর বাড়ানোর প্রবণতা বন্ধ হবে। শেয়ারের দর বাড়বে কিন্তু সময় নিয়ে বাড়বে।’
আনুপাতিক হারে শেয়ার বণ্টনের ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের আইপিওতে নিরুৎসাহিত করবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত কোনো প্রভাব ফেলবে না; বরং আনুপাতিক হারে শেয়ার বণ্টনের ক্ষেত্রে যে কোটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা এই প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করবে। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য কোম্পানির শেয়ারের এক অংশ রেখে আনুপাতিক হারে শেয়ার বণ্টন সঠিক হতে পারে না।
‘কোটা ব্যবস্থা রাখতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগসীমার ওপর ভিত্তি করে কোটা দেয়া উচিত। একই সঙ্গে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ও বিনিয়োগ অনুযায়ী কোটার ব্যবস্থা করা যায়। এতে পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি হবে।’
ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিএসইসি এ সময়ে যতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে ভালো হয়েছে। এতে নতুন শেয়ারের দর দ্রুত বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ হবে।’
এতে আইপিও আবেদনে আগ্রহ ও বিনিয়োগ কমে আসবে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা হওয়ার কথা না। কারণ বিও অ্যাকাউন্টে ২০ হাজার টাকা রাখার যে কথা বলা হচ্ছে, সেটি থাকলে আপনি আইপিওতে আবেদনের জন্য যোগ্য হবেন। যোগ্য হলেও অনেকে আইপিওতে যেতে চান না।’
বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত না নিয়ে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করা উচিত ছিল। আনুপাতিক শেয়ার বণ্টনের পরিপ্রেক্ষিতে আইপিও শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের যে আগ্রহ ছিল সেটি কমে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘আইপিওর সঙ্গে অবশ্যই শেয়ার দরের সম্পর্ক আছে। আইপিওতে প্রাপ্ত শেয়ার লাভ না হলে কেউ আবেদন করবে না।
‘শেয়ারদর বাড়ার সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় এখন ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে আইপিও শেয়ারের আবেদন করতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে আসবে।’