করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার পেটেন্ট ও লাইসেন্স দ্রুত উন্মুক্ত করার দাবি উঠেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত এক আলোচনায়।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ করোনাভাইরাসের টিকার জন্য অপেক্ষা করছে। আগে টাকা দিয়েও অনেকে কাঙ্ক্ষিত টিকা পাচ্ছে না। অথচ টিকার পেটেন্ট ও লাইসেন্স উন্মুক্ত হলে এই দেশগুলো নিজেরাই টিকা উৎপাদন করতে পারত। কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না।
‘শিল্পায়ন: শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শিরোনামে শনিবার অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত ওয়েবেনিয়ারে অংশ নিয়ে বক্তারা এ দাবি জানান।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও করোনা মহামারি থেকে উত্তরণ এবং বৈষম্য-অসমতা দূরীকরণে ‘শোভন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্বায়ন নয় দেশজায়ন’ এর পক্ষে মত দেন আলোচকরা।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাতের সদ্য প্রকাশিত ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ গবেষণা গ্রন্থটির বিষয়বস্তু ঘিরে ১৩ সিরিজের আলোচনা সভার এটি ছিল অষ্টম পর্ব।
এতে আলোচক হিসেবে অংশ নেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান এবং অর্থনীতি সমিতির সহসভাপতি আব্দুল হান্নান। সভা সঞ্চালনা করেন অর্থনীতি সমিতির যুগ্ম সম্পাদক লিয়াকত হোসেন মোড়ল।
মোস্তাফিজুর বলেন, ‘এ বইটা কেবল অধ্যাপক আবুল বারকাতের পক্ষেই লেখা সম্ভব। এতে তার মৌলিক ধারণা বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের চিন্তার জোগান দিচ্ছে; সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিচ্ছে।
‘কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বিশ্বায়ন বিষয়টা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। করোনাভাইরাস যে বিস্তৃত হয়েছে, এটা বিশ্বায়নেরই ফল। সারা বিশ্বে এটা ছড়িয়ে পড়েছে। এর সমাধান খুঁজতে গেলেও বিশ্বায়নেরই নানা প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হয়। কিন্তু ভ্যাকসিনের পেটেন্ট ও লাইসেন্স যদি উন্মুক্ত করা যেত আমাদের মতো দেশগুলো নিজেরাই টিকা উৎপাদন করতে পারত। কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অধ্যাপক বারকাত তার লেখায় তিনটি জিনিস এনেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে বিশ্বায়নের সম্পৃক্ততা ও চ্যানেলগুলো নিয়ে। আলোচনায় এসেছে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া আমাদের দেশে কেমন অভিঘাত এনেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের মতো বিশ্বায়নের প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা।’
করোনা প্রাকৃতিক প্রতিশোধ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে উল্লেখ করে খালেকুজ্জামান বলেন, ‘মহাবন আমাজন থেকে শুরু করে সুন্দরবন ধ্বংস করে চলেছে বিশ্বায়নের অনুষঙ্গ। এ বিশ্বায়ন নিয়ে যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও বিকল্প প্রস্তাবনার জন্য অধ্যাপক আবুল বারকাতকে আমাদের দল বাসদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই।’
আব্দুল হান্নান অধ্যাপক বারকাতের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘বিশ্বায়ন দুর্ভাবনার বিষয়। ততধিক দুর্ভাবনার বিষয় নব্য উদারবাদী বিশ্বায়ন। এমনও প্রশ্ন উঠেছে যে মহামারি কী বিশ্বায়ন উদ্ভূত বিপর্যয়?
‘একদিকে প্রচলিত বিশ্বায়নের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা আর অন্যদিকে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ পাল্টে দিচ্ছে বিশ্বায়নের চরিত্র।’
বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে প্রবাসীদের কষ্টমূল্য বিবেচনায় নিয়ে প্রবাসে শ্রমবাজারের সঠিক মূল্যায়ন করতে না পারার অনুযোগ জানান তিনি।
মহামারিতে টিকা জাতীয়তাবাদের উত্থান, কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকারত্ব বৃদ্ধির হতাশার মধ্যে ‘শোভন সমাজের লক্ষ্যে বিশ্বায়নের বদলে দেশজায়নের’ কথা জানান আব্দুল হান্নান।
সভার শুরুতে অধ্যাপক আবুল বারকাতের স্ত্রী শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সাহিদা আখতারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়।
সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন আহমেদ, সহ সম্পাদক শেখ আলী আহমেদ টুটুল ও সমিতির রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মাজহার সরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের ২০ বছরের গবেষণার ফসল ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ বইটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা।
৭১৬ পৃষ্ঠার এ বইটি সম্পর্কে অভিনন্দনবাণী দিয়েছেন ভাষাবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও সমালোচক অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি।