প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ থাকছে। করোনার সংকট মোকাবিলায় যেকোনো জরুরি চাহিদা মেটাতে এ অর্থ ব্যয় করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে নিয়মিত যে পরিমাণ বরাদ্দ রাখা হয়, এই বরাদ্দ তার বাইরে। মূলত করোনার টিকা কিনতে বাড়তি ব্যয়ের চাহিদা পূরণে থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে। পাশাপাশি সুরক্ষাসামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও কেনা যাবে এ তহবিল থকে।
গত বছরের মার্চে দেশে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রক্ষিতে এটি মোকাবিলায় বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ বাবদ রাখা হয়েছিল। দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে এবং তা আগের চেয়ে ভয়াবহ। এটি নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে ১৬ মে পর্যন্ত দেশব্যাপী লকডাউন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনা সহসাই যাচ্ছে না এবং তৃতীয় ঢেউ যে আসবে না, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। ফলে করোনা নিয়েই থাকতে হবে। কিন্তু এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ জন্য জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে। করোনা প্রতিরোধে টিকার কার্যক্রমসহ চলমান কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের বেশ কিছু টাকা ফেরত যায়, খরচ করার অপরাগতার জন্য। স্বাস্থ্য বিভাগে উপযুক্ত, যোগ্য মানুষের অভাব রয়েছে। এ খাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে। কমাতে হবে দুর্নীতি। তা হলে সক্ষমতা বাড়বে।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তরা বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এ জন্য ‘বাড়তি’ ব্যয়ের প্রস্তাব করা হচ্ছে। তবে থোক বরাদ্দ থেকে মূলত টিকা কেনার জন্য ব্যয় করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশের ১২ কোটি জনগণকে করোনার টিকা দেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। ফলে সবাইকে টিকা দেয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।’
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকার পরবর্তী চালান দিতে ভারতের বিলম্বের কারণে বাংলাদেশে গণটিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৩ কোটি ডোজ টিকা কেনার বিষয়ে গত ডিসেম্বরে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়। সিরাম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে এ টিকা সরবরাহ করছে।
চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি ডোজ ৫ ডলার করে সিরামের প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার কথা বাংলাদেশকে। গত ২৫ জানুয়ারি ৫০ লাখ ডোজের প্রথম চালান দেশে এসেছে। এর বাইরে ভারত সরকার আরও ২০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশকে উপহার দেয়।
চাহিদা অনুযায়ী টিকা তৈরি করতে না পারায় সিরামের পরের চালান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশে করেনার টিকা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় টিকা সংগ্রহের বিকল্প পথ খুঁজছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে চীন ও রাশিয়ার উদ্ভাবিত টিকা আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে টাকার কোনো সমস্যা হবে না। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ব্যয়ের নির্দিষ্ট সীমা দেয়া হলেও করোনায় সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা প্রযোজ্য নয়। প্রয়োজনে যা দরকার, তাই দেয়া হবে।
গত সপ্তাহে ক্রয় কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, করোনা মহামারি মোকাবিলায় যা কিছু করণীয়, তার সব কিছু সরকার করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আগামী বাজেটে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বাজেট সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতির বেশির ভাগই স্বাস্থ্য খাতের।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল -ফাইল ছবি
আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়
চলতি অর্থবছরে করোনা মোকাবিলায় থোক বরাদ্দের ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার খরচ করেছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। এর বড় একটি অংশ খরচ হয় সিরামের টিকা কেনায়।
অর্থ মন্ত্রণালয় কর্মকর্তরা বলেছেন, অবশিষ্ট টাকা রাশিয়া ও চীন থেকে টিকা কেনায় ব্যয় করা হবে। শিগগিরই এ টাকা ছাড় করা হবে।
চলতি অর্থবছরে অনুন্নয়ন এবং উন্নয়ন মিলে স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয় ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত গড়ে বরাদ্দের মাত্র ৩২ শতাংশ খরচ হয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, টিকা কেনার প্রস্তুতি চলছে। চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আরও ডাক্তার, নার্স ও মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান নিয়োগ করা হচ্ছে।
এ ছাড়া করোনায় মৃত্যুজনিত কারণে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মানী ভাতা দেয়া হবে।
এসব ব্যয় নির্বাহের ফলে অর্থবছর শেষে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় আরও বাড়বে বলে মত প্রকাশ করেন কর্মকর্তারা।
গবেষণায় বরাদ্দের এক টাকাও খরচ হয়নি
স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে চলতি অর্থবছরের বাজেটে সমন্বিত একটি গবেষণা তহবিল গঠন করা হয়। এ তহবিলে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। অর্থবছরের দশ মাস পার হলেও গবেষণা কাজে এক টাকাও খরচ হয়নি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেছেন, গবেষাণায় কীভাবে টাকা খরচ করা হবে, কোথায় খরচ করা হবে– সে বিষয়ে আলদা নীতিমালা তৈরি করতে হবে। এ নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। এটি চূড়ান্ত হ্ওয়ার পর তহবিলের টাকা ছাড় হবে।
এ তহবিলের অগ্রগতি নিয়ে গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়।
অর্থমন্ত্রণালয় থেকে টাকা খরচ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, শিগগিরই এ সংক্রান্ত খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। তারপর প্রজ্ঞাপন জারি করে তা কার্যকর হবে।