পোশাকশ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে আর কোনো টাকা দেবে না সরকার।
ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পোশাকশিল্প মালিকরা সরকারের কাছে যে টাকা চেয়েছিলেন তাতে সাড়া মেলেনি।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সরকারের উপরের মহল বা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো খবর না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতের শিল্পমালিকরা।
এখন নিজেদের উদ্যোগেই ঈদের আগে বেতন-বোনাস দেয়ার চেষ্টা করছেন তারা। সবাই দিতে পারবেন কি না তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার আমাদের আবেদনে কোনো সাড়া দেয়নি। আর সময়ও নেই। এই সপ্তাহ শেষ হয়ে গেল। শুক্র-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। ঈদের আগে ব্যাংক খোলা আর তিন দিন।
‘এর মধ্যে কী করে কী হবে বুঝতে পারছি না। সরকারের কাছ থেকে কোনো ঋণ বা প্রণোদনা পাওয়া যাবে না-এটা আমরা নিশ্চিত হয়ে গেছি। এখন আমরা নিজেরা চেষ্টা করে ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেয়ার চেষ্টা করছি।’
ফারুক বলেন, ‘আমরা এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন-ভাতা দিতে সরকারের কাছে ঋণ হিসেবে টাকা চেয়েছিলাম। সরকার যদি এক মাসেরও দিত তাও আমাদের উপকার হতো। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারতাম।’
গত ২৫ এপ্রিল শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে সরকারের কাছে ফের টাকা চেয়েছিলেন পোশাকশিল্প মালিকরা। ঈদের আগে আর্থিক সংকটের কথা বলে এই টাকা চেয়েছিলেন তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা।
গতবারের মতো এবারও ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে এপ্রিল, মে ও জুন—এই তিন মাসের বেতন-ভাতা ও বোনাস দেয়ার জন্য ঋণ চেয়েছিলেন তারা।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান এবং বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ২৫ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে চিঠি দিয়ে ঋণ দেয়ার অনুরোধ করেন।
চিঠির অনুলিপি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবরও পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বিশ্বের অনেক দেশই আগের মতো লকডাউনে রয়েছে। ফলে যেসব ক্রেতা অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারাও এখন অপারগতা প্রকাশ করছে। এমন অবস্থায় ঈদের আগে সচল কারখানাগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও বোনাস প্রদানের জন্য মালিকদের ওপর প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে শ্রমিকের বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিশোধে অর্থের জোগান দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পকে সহায়তা করার জন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন-ভাতা ও বোনাস দেয়ার জন্য আগের মতো সহজ শর্তে ঋণ দেয়া প্রয়োজন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
করোনার কারণে গত বছর মার্চে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশ আসতে থাকে। তখন পোশাকশিল্পের মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রপ্তানিমুখী শ্রমিকদের এপ্রিল, মে ও জুন—তিন মাসের মজুরি দেয়ার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে।
এই ঋণের বিপরীতে সেবা মাশুল ছিল ২ শতাংশ। পরে পোশাকশিল্পের মালিকেরা আরও এক মাসের মজুরি দেয়ার জন্য ঋণ দেয়ার দাবি করেন। সরকারও মেনে নেয়।
তখন তহবিলের আকার বেড়ে ৯ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা দাঁড়ায়। তবে চতুর্থ মাসের জন্য ঋণের মালিকদের সুদ দিতে হবে সাড়ে ৪ শতাংশ। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ ভর্তুকি দেবে সরকার।
রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য প্যাকেজটি ঘোষিত হলেও তহবিল থেকে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানামালিক ঋণ নিয়েছেন। এই ঋণের গ্রস পিরিয়ড ছিল ছয় মাস। পরবর্তী ১৮ মাসের কিস্তিতে সেই ঋণ পরিশোধের শর্ত ছিল।
তবে গত বছরের শেষ দিকে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ প্রণোদনার ঋণের গ্রস পিরিয়ডের সময় বাড়ানোর দাবি জানায়। সরকারও তা মেনে নেয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে প্রণোদনা তহবিল থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধে ১ মার্চ থেকে বাড়তি ছয় মাস সময় দেয়ার নির্দেশনা দেয়। তার ফলে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে ঋণের কিস্তি দিতে হবে মালিকদের।
ফারুক হাসান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পে সংকট চলছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সেই সংকট আরও বেড়ে গেছে।
ঈদের আগে পাওনা টাকার দাবিতে গাজীপুরে পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ। ছবি: নিউজবাংলা
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘এই কঠিন পরিস্থিতিতে ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতনভাতা-বোনাস দেয়ার মতো টাকা কোনো মালিকের নেই। ঈদের আগে বেতন-বোনাস না দিতে পারলে কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে।
‘সে কারণেই আমরা তিন সংগঠন মিলে সরকারের কাছে জরুরি ভিত্তিতে গত বছরের মতো ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ চেয়েছিলাম। আশা করেছিলাম সরকার ইতিবাচক সাড়া দেবে। কিন্তু সেটা হলো না। এখন পরিস্থিতি কী হবে বুঝতে পারছি না। সব মালিককে অনুরোধ করেছি, কষ্ট করে হলেও ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতান-বোনাস যেন দিয়ে দেয়।’
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই কঠিন পরিস্থিতিতে সরকার আমাদের সহায়তা না করায় আমরা হতাশ হয়েছি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বর্তমানে পোশাক রপ্তানির অর্থ সময়মতো দিচ্ছে না অনেক ক্রেতা। তারা ৬০ থেকে ১৮০ দিন পর্যন্ত সময় চাইছে। এ ছাড়া অনেক ক্রেতাকে মূল্যছাড়ও দিতে হচ্ছে।
‘ঈদের আগে বেতন-ভাতা ও ঈদ বোনাস দিতে অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ কারখানামালিকদের হাতেই পর্যাপ্ত অর্থ নেই। সে কারণেই আমরা সরকারের কাছে ঋণ চেয়েছিলাম।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিন সংগঠনের আবেদন পাওয়ার পর আমরা সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক কিছু জানানো হয়নি।’