বাজারে টাকার অতিরিক্ত সরবরাহে বাড়ে মূল্যস্ফীতি। কারণ, মানুষের হাতে অর্থের প্রবাহ বেশি থাকলে, পণ্যের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু এখন মানুষের হাতে টাকা নেই, চাহিদাও সীমিত। তারপরও মূল্যস্ফীতির হার কেন বাড়ছে?বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুর্বল বাজারব্যবস্থাপনাই এর কারণ। অন্য যে কারণে পণ্যের দাম বাড়ে, তা এখন অর্থনীতিতে অনুপস্থিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের আয় অনেক কমে গেছে। ব্যাপক টাকা ব্যাংকে আছে, কিন্তু মানুষের কাছে নেই। টাকা নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে চলে যাচ্ছে। ফলে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ থাকলেও টাকার ব্যবহার কম।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বর্তমানে চাহিদার তুলনায় বাজারে টাকার প্রবাহ কম। ব্যাংকে তারল্য আছে, কিন্তু মানুষের হাতে টাকা নেই। টাকার প্রবাহ কম থাকায় পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।বাজারে টাকার প্রবাহ কম
বর্তমানে বাজারে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ শতাংশ, যা খুব কম।গত জুলাইতে এক বছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়, সেখানে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে ৬ মাস পর জানুয়ারিতে মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্য কমিয়ে ১৫ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বলা হচ্ছে, সাধারণত মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ থাকলে তা স্বাভাবিক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৬৪ ভাগ। জানুয়ারিতে সেটা কমে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ১৯ ভাগ।
টাকার প্রবাহ কম থাকায় বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছবি: নিউজবাংলা
২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়েছিল ৭ দশমিক ১২ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বাজারে টাকার প্রবাহ বেশি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ।
যে হারে টাকার প্রবাহ বাড়ানো হয়েছে, সে হারে ব্যবহার বাড়েনি। ফলে সরবরাহ করা বাড়তি টাকা ব্যাংকগুলোর ভল্টে অলস পড়ে আছে।
ব্যাংকে তারল্য, হাতে টাকা নেই
ব্যাংকে তারল্য আছে। কিন্তু মানুষের হাতে টাকা নেই। ব্যাংকের বাইরে যে টাকা থাকে, সেটাকে টাকার প্রবাহ বলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংক খাতে তারল্য দাঁড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকা, এক মাস আগে যা ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৭০ কোটি টাকা। আর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা।
বিশাল এই তারল্যের একটি বড় অংশ বিলবন্ডে বিনিয়োগ করেছে। বাকি টাকা ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে আছে।
গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে গ্রাহকদের ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তোলার চাহিদা অনেক বেড়েছে। তারপরও ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে আছে।বাড়তির দিকে আমানত
ব্যাংকে আমানতকারীদের টাকা জমা রাখার প্রবণতা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমানত বেড়েছিল ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
এর মধ্যে চলতি আমানত গত অর্থবছরে কমেছিল ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে একই সময়ে বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ।মেয়াদি আমানত গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির কারণ দুর্বল ব্যবস্থাপনা
লকডাউনের সময় মানুষ আতঙ্কে বেশি পণ্য কেনে। এর সুযোগ নেয় ব্যবসায়ীরা। বাজারে পণ্য থাকা সত্ত্বেও কিছু ব্যবসায়ী এ সুযোগে দাম কিছুটা বাড়িয়ে মুনাফা করেন। তবে এর জন্য ব্যবসায়ীদের চেয়ে সরবরাহব্যবস্থার বিশৃঙ্খল-ব্যবস্থাকে মূল্যস্ফীতির জন্য বেশি দায়ী করে বিশেষজ্ঞরা।
বাজারে পণ্য থাকা সত্ত্বেও কিছু ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়ে মুনাফা করেন। ছবি: নিউজবাংলা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত মার্চ মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে গত কয়েক মাস ধরেই ঊর্ধগতি। জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এই সূচক।মার্চে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ; জানুয়ারিতে যা ছিল ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, লকডাউনের কারণে বাজারে পণ্য সরবরাহ কম। সময়মতো পণ্য আসছে না। যেকোনো পণ্য বিভিন্ন জায়গা থেকে আনতে হয়। তবে চাহিদাও খুব বাড়েনি। ব্যবসায়ীরাও কারসাজি করে। কম দামে পণ্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করছে। বাজারে কোনো তদারকি নেই। পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। সমন্বয়ের অভাবের কারণে বাজারব্যবস্থার এই অবস্থা।সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা, বাজার তদারকির অভাব, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেয়া এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে দুর্বল ব্যবস্থাপনা মূল্যস্ফীতির কারণ।