গাজীপুরের টঙ্গীর সাতাঈশ গুটিয়া এলাকায় বর্তমানে কয়েকটি ঘরে কর্মরত রয়েছেন তাঁত শিল্পীরা। তাদের নিপুণ হাতের কর্মকুশলতায় তৈরি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী জামদানি, কাতান ও বেনারসি শাড়ি। বহুবিধ সংকটে অনেকেই গুটিয়ে নিয়েছেন পৈত্রিক ব্যবসা। ভারতীয় শাড়ির অবাধ প্রবেশে চরম হুমকির মুখে বিশেষায়িত এ শিল্প। আর্থিক সংকটে আছেন তাঁত শিল্পীরা। এ অবস্থায় সরকারি প্রণোদনা ও কারিগরি সহযোগিতা না পেলে গুটিয়ার ‘তাঁতপল্লী’ হারিয়ে যাবে বলে শঙ্কা তৈরী হয়েছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কর্মকর্তারা জানান, তাঁত শিল্প রক্ষায় আর্থিক সহায়তার পরিকল্পনা বিবেচনায় রয়েছে। গুটিয়া গ্রামে জামদানি, কাতান ও বেনারসি শাড়ি বুননে মাত্র তিনশ ঘর তাঁতি এখনও টিকে আছেন। এক সময় প্রায় ৩০০ কারখানায় দুই হাজারের বেশি তাঁতকল ছিল। সে সময় জামদানি শাড়ির বাণিজ্যও ছিল রমরমা। বর্তমানে ভারতীয় শাড়ির অবাধ প্রবেশ, শিল্পায়ন, সুতার দাম বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকটসহ নানা সমস্যায় এই শিল্প এখন বন্ধের পথে।
মিজানুর রহমান নামে এক বেনারসি কর্মী বলেন, ‘ভারতের যে শাড়িগুলো আসে, সেগুলো না এলে দেশি জামদানি ও বেনারসির চাহিদা থাকত। আগের তুলনায় আমাদের বাজার কমে যাওয়ায় তেমন মজুরি পাচ্ছি না। মাসে যা উপার্জন, তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলে না। এখন পেশা ছেড়ে দেবার অবস্থা।’
গুটিয়া এলাকায় গত ৩০ বছর ধরে তাঁতের কাজ করছেন আব্দুল আজিজ মিয়া। কারখানার পাশেই নয় সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস। তিনি বলেন, ‘আগে জামদানি, বেনারসি বুনে বেশ সুযোগ-সুবিধা পাওয়া গেছে। তখন বাজারে চাহিদা ছিল। এখন বাজার মন্দা, মহাজন সুবিধা করতে পারছেন না। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কমে গেছে তাঁতির সংখ্যা।’
তাঁত কারিগর গফুঁর মিয়া জানান, প্রতি শাড়ির জন্য তিনি মজুরি পান ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। সব মিলিয়ে একটি শাড়ি তৈরিতে খরচ হয় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। মানভেদে এসব শাড়ি বাজারে বিক্রি হয় দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। সুতার দাম বৃদ্ধি এবং ক্রমাগত লোকসানের কারণে অনেকে তাঁত বন্ধ করে দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, ভারত থেকে নানাভাবে আসা শাড়ি এখন অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। সমমানের না হলেও সেসব শাড়ি কম দামে কেনা যাচ্ছে। বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না দেশি জামদানি ও বেনারসি শাড়ি। নানা রকম সংকটে শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
আব্দুল কাদের মুন্সি নামের কারখানা মালিক জানান, তার কারখানায় তাঁত কল রয়েছে ১৬টি। সেখানে সপ্তাহে প্রায় ২০০ বেনারসি ও কাতান শাড়ি তৈরি হয়। এসব শাড়ি রাজধানীর মিরপুরসহ সারা দেশে পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, ‘জামদানি, বেনারসি ও কাতান শাড়ির চাহিদা আগের তুলনায় কমে গেছে। সুতা খারাপ থাকলেও ভারতীয় শাড়ির দাম কম থাকায় তা কিনছেন মানুষ। আমাদের সুতা ভালো হলেও দাম বেশি বলে বিক্রিতে মন্দাভাব।’
গুটিয়া এলাকার বাসিন্দা মো. মুসলেম বলেন, ‘বাজার মূল্য না পেলেও অনেকে শুধু ঐতিহ্য ধরে রাখতে ব্যবসা করছেন। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখছেন অনেক কষ্ট করে। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পেলে তারা বেশিদিন লড়াই চালিয়ে যেতে পারবেন না।’
টঙ্গীর বিসিক কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক রাজীব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভারতের শাড়ির অবাধ প্রবেশ ও বিক্রির কারণে দেশীয় তাঁতশিল্প টিকতে পারছে না। বিসিক নিজস্ব কর্মসূচির আওতায় এবং কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তাঁতশিল্পে জড়িতদের তালিকা তৈরি করে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি সংকট উত্তরণের চেষ্টা চলছে।’
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘গাজীপুরের মধ্যে টঙ্গীর সাতাঈশ গুটিয়া এলাকার তাঁতশিল্পের অনেক সুনাম রয়েছে। বর্তমানে তাদের কী ধরণের সমস্যা রয়েছে, সেটি আমার জানা নেই। একটি টিম পাঠিয়ে এ ব্যাপারে খোঁজ নেয়া হবে।’