শরীয়তপুরের মৃৎশিল্পের সুখ্যাতি দীর্ঘদিনের। যুগ যুগ ধরে চলে আসা শিল্পটি প্লাস্টিক, মেলামাইন আর ধাতব পণ্যের ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল।
ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং জীবিকার তাগিদে জেলার পাল বংশের নতুন প্রজন্ম তাই এই শিল্পে এনেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। নকশা ও পণ্যে আনা হয়েছে নান্দনিকতা। এতেই মিলেছে সাফল্য।
দেশের নামিদামি প্রতিষ্ঠানে বিক্রির পাশাপাশি নিত্যনতুন নকশায় তৈরি এসব পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আসায় সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের অর্থনীতিও।
জেলার পাল বংশের মানুষরা মূলত গৃহস্থালির বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি করত। ঘরে ব্যবহৃত মাটির থালাবাসন, কলস, হাঁড়ি, পাতিল, বদনা, মটকাজাতীয় পণ্যই তারা এত দিন তৈরি করে আসছিলেন।
তবে আধুনিক প্রজন্ম তৈরি করছে নান্দনিক শিল্পমূল্যের মাটির পণ্য। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য বিশেষ চুল্লি, চাকা আর মাটির মিশ্রণ যন্ত্র ব্যবহার করছেন তারা। শহুরে জনগোষ্ঠী আর বহির্বিশ্বের চাহিদা মাথায় রেখে করা হচ্ছে নিত্যনতুন নকশা।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে শোপিস বা ডেকোরেশনের ধরনেও আনা হয়েছে পরিবর্তন।
এ অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের সংগ্রহে রয়েছে হাজারও ধরনের দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম। ফুলদানি, মোমদানি, কলমদানি, হারিকেন, পুতুল, সাইকেল, প্যাঁচা, ঘোড়া, হাতি, পাখির বাসা, বজ্রনৌকা, খরগোশ, কচ্ছপ, ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, ফলের ট্রে, চায়ের ট্রে, ওয়াল ম্যাট, আর্কষণীয় টালিসহ বৈচিত্র্যময় পণ্য।
ভেদরগঞ্জ উপজেলার কার্তিকপুর পাল পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষ সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে।
কেউ মাটি প্রস্তুত করছেন, কেউ ব্যস্ত দৃষ্টিনন্দন নকশা তৈরিতে, কেউবা শুকাচ্ছেন তৈরি করা পণ্যগুলো। এসব পণ্য পোড়ানোর কাজেও রয়েছেন অনেকে। রংতুলিতে পণ্যগুলো আকর্ষণীয় করে তুলছেন আরেক দল কারিগর। কেউ আবার ব্যস্ত পণ্যগুলো বাছাই করে মোড়ক দিতে।
রূপক পাল নামে তাদেরই একজন বজ্রনৌকায় নকশা করছিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি জানান, করোনা সত্ত্বেও আমাদের পণ্যের চাহিদা খুব একটা কমেনি। কারণ তাদের মৃৎশিল্পের গুণগতমান আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্য তৈরি করায় অর্ডার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘করোনার প্রভাবে মৃৎশিল্পগুলো বিলুপ্তির পথে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি। কারণ, বায়ারদের অর্ডার বন্ধ ছিল না বা কমেনি। শুধু বিদেশে যাওয়ার কারণেই এই শিল্প এখন এগিয়ে যাচ্ছে। তা না হলে এত দিনে বন্ধ হয়ে যেত।’
সরকার যদি পাশে থেকে রপ্তানির ক্ষেত্রে আরও সহযোগিতা করে তাহলে তারা আরও লাভবান হবেন। পাশাপাশি শিল্পে কর্মসংস্থানও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
ওই কারখানার নারী কারিগর আলো রানী মণ্ডল বলেন, ‘২০ বৎছর ধইরা কাজ করতাছি। কাজের টাকা জমাইছি। হেই টাকা অইতে ছেলেডার বিয়াতে এক লাক টাকা খরচ করছি। কাজ কইর ভালো আছি।
‘সংসারে খরচ করতে পারি, আবার জমাইতেও পারি। দিন দিন কাজ বাড়তাছে। সামনে আরও আয় বাইড়া যাইব।’
পাশের বাড়ির বিপ্লব পাল উঠানে বসে ক্যান্ডেল হাউসের কাজ করছিলেন। তার স্ত্রী সোমা রানী ঘরে বসে পলিশ করছিলেন মাটির কচ্ছপের গায়ে।
কথা হয় সোমা রানীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এগুলো পটারির কাজ। এগুলো বিদেশ যাবে। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনেক যত্নসহকারে ও সাবধানে করে থাকি। যাতে কোনো সমস্যা না হয়।
‘কারণ এই জিনিসগুলো বিদেশ যাবে। নিখুঁতভাবে কাজগুলো না করলে বিদেশে যাবে না।’
শিল্পীদের মেধা ও হাতের নিপুণ কারুকার্যে তৈরি করা এসব মাটির পণ্য এরই মধ্যে দৃষ্টি কেড়েছে বর্তমান প্রজন্মের। আলাদা নান্দনিক শিল্পমূল্য থাকায় এমনিতে মাটির পণ্য পছন্দ করেন অনেকে। এর সঙ্গে পরিবেশবান্ধব এবং পণ্যের বৈচিত্র্য থাকায় প্রতিনিয়তই আগ্রহ বাড়ছে ক্রেতাদের।
ক্রেতা বাড়ায় দিন দিন বড় হচ্ছে এসব পণ্যের বাজার। যেখানে একসময় শুধু গ্রামগঞ্জে ফেরি করে মাটির পণ্য বিক্রি করা হতো। এখন রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে আলাদা দোকানের পাশাপাশি রাস্তার পাশেও অনেকে এসব পণ্য বিক্রি করেন।
গ্রাহকের চাহিদা পূরণে আড়ং, বিবিয়ানা, হীড বাংলাদেশ, কোড় দি জুট ওয়ার্কস, উষা হ্যান্ডি ক্রাফটসের মতো দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোও মাটির তৈরি এসব পণ্য বিক্রি করছে।
নান্দনিক মূল্য থাকায় এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অন্তত ২৫টি দেশে এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
জয়পাল নামে এক কারিগর জানান, রাজধানীর গুলশানের একটি প্রতিষ্ঠান তার কাছ থেকে পণ্যের নমুনা নেয়। এরপর তারা বিমানে সেই নমুনা বিদেশে ক্রেতাদের কাছে পাঠায়। ক্রেতা পছন্দ করলে মোংলা বা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জাহাজের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করা হয়।
তিনি আরও জানান, এ অঞ্চলের অধিকাংশ মৃৎশিল্পীর কাছ থেকে প্রথমে পণ্য কেনে দেশি কোনো প্রতিষ্ঠান। পরে তারা বিদেশে সেই পণ্য পাঠায়।
মধ্যস্বত্বভোগী এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে বিদেশে রপ্তানি বাড়লেও তারা সেভাবে লাভবান হচ্ছেন না অভিযোগ করেন জয়পাল।
করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেটিও এ অঞ্চলের মৃৎশিল্পে প্রভাব ফেলেছে বলে জানান কারিগররা। তারা জানান, বিদেশের অর্ডার খুব একটা কমেনি, তবে ১৪ দিন ঘরে রেখে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা থাকায় আগের মতো দ্রুত পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না।
রূপক পাল জানান, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর দেশীয় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অর্ডার স্থগিত করেছে। অর্ডার বাতিল না করলেও লকডাউনের পর পণ্য নেবে বলে জানিয়েছে। আবার বিদেশে পণ্য পাঠানোয়ও ধীরগতি তৈরি হয়েছে। আগে যে সময়ে পাঁচবার পণ্য পাঠানো যেত, এখন দুইবার যাচ্ছে।
মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিরিক্ত লাভের কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসানও। তিনি বলেন, ‘শরীয়তপুরের মৃৎশিল্পের পণ্যগুলো আমি দেখেছি। তাদের কাজ আমাকে মুগ্ধ করেছে। যে পণ্যগুলো তৈরি করা হচ্ছে তা সুদৃশ্য এবং আকর্ষণীয়। তবে সে অনুযায়ী মূল্য পাচ্ছেন না তারা। মধ্যস্বত্বভোগীরা ফায়দা লুটছে।’
তিনি জানান, মৃৎশিল্পীরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান সে জন্য উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে সরাসরি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ চলছে। ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে পণ্যগুলো তুলে ধরা হবে। এতে করে আন্তর্জাতিক বাজারও সম্প্রসারিত হবে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেন, ‘দেশীয় সব ধরনের শিল্পের প্রসার ও উন্নয়নে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। মৃৎশিল্প শরীয়তপুরের একটি ঐতিহ্য। এখানকার পণ্য এখন দেশের অভিজাত এলাকার ঘরে ঘরে শোভা পাচ্ছে।
‘বিক্রি হচ্ছে বড় শোরুমগুলোতে। যাচ্ছে বিদেশেও। এ শিল্প থেকে যাতে বৈদেশিক মুদ্রা আরও বেশি পরিমাণে আয় করা যায় সেটা নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা আছে। আন্তর্জাতিকভাবে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে সরকার কাজ করছে। আগামীতে মৃৎশিল্প হবে শরীয়তপুরের অন্যতম কারুশিল্প।’