বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তরমুজের কেজি হওয়া উচিত ৩০ টাকার মধ্যে

  •    
  • ৪ মে, ২০২১ ১২:১৪

ঢাকার আড়তে শ হিসেবে তরমুজ বিক্রি হলেও সেখানে যে দাম, তাতে প্রতি কেজি হিসাব করলে পড়ে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ টাকা। কেজিপ্রতি ৩ টাকা পরিবহন খরচ আর ২ টাকা অপচয় ধরলেও দাম পড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা। আইন অনুযায়ী, প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ ৫ টাকা মুনাফা করা যায়। সে হিসেবে অনুমোদিত দামের দ্বিগুণে বিক্রি হচ্ছে মৌসুমি ফলটি।

বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাটের তরমুজচাষি বরকত হোসেন নিজের ক্ষেতের সবচেয়ে বড় আকারের ১৫ কেজি ওজনের প্রতি শ তরমুজ সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। আকারে ছোট হলে দাম আরও কম।

অর্থাৎ প্রতিটির দাম পড়েছে ১৮০ টাকা। কেজি পড়ে ১২ টাকার মতো।

কিন্তু সেই তরমুজই ঢাকাসহ সারা দেশে খুচরায় বিক্রি হচ্ছে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি দামে, ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে।

কৃষকের হাত থেকে খুচরা পর্যায়ে আসার পর তরমুজের দাম এত বাড়ে কেন, তার কারণ বের করার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। দেখা যায়, কৃষকের হাত থেকে যাওয়ার পর প্রতি ধাপে অনুমোদিত হারের চেয় বেশি দাম বাড়ে। আর সবচেয়ে বেশি বাড়ে খুচরা পর্যায়ে।

কৃষি বিপণন আইন মানলে ঢাকার ভোক্তারা ৩০ টাকা কেজি দরে ফলটি খেতে পারতেন। কিন্তু তীব্র গরম আর রোজায় চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

শহরের বিভিন্ন এলাকায় খুচরা ব্যবসায়ীদের মোটামুটি একই দামে তরমুজ বিক্রি করতে দেখা যায়। এতে এটা বোঝা যায়, তারা দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে এককাট্টা।

তবে সম্প্রতি দেশজুড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযানের পর ফলটির দাম পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কিছুটা কমার প্রমাণ মিলেছে।

কৃষক পর্যায়ে কত দাম, আড়তেই বা কত

চাষিদের হাত থেকে তরমুজ প্রথমে যায় পাইকারি ব্যবসায়ী বা ফড়িয়াদের হাতে। তারা এ তরমুজ বিক্রি করেন মোকাম বা আড়তে। আর আড়ত থেকে থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারি দরে শ হিসেবে কিনে খুচরা বাজারে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন কেজি হিসেবে।

বরকত হোসেনসহ বরিশালের লাহারহাটের কয়েকজন তরমুজচাষি। তারা নিউজবাংলাকে জানান, ৭ থেকে ১০ কেজি ওজনের তরমুজ প্রতি শ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। প্রতিটির দাম পড়ে ১০০ টাকা। কেজিতে দাম ১০ থেকে ১৪ টাকা পড়ে।

তিন থেকে ছয় কেজি ওজনের তরমুজের শ ৫ হাজার টাকা দেন আড়তের মহাজন। প্রতিটির দাম হয় ৫০ টাকা। কেজি হিসেবে দাম পড়ে ৮ থেকে ১৬ টাকা।

দেশের সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয় বরিশাল বিভাগে, এরপরই খুলনা।

খুলনার বটিয়াঘাটার দেবীতলার চাষি গোবিন্দ রায় বলেন, এ বছর তিনি ৯ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। বর্তমানে প্রতি বিঘায় প্রায় ১ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি হচ্ছে।

এক বিঘায় বিভিন্ন আকারের তরমুজ মিলে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ তরমুজ হয়। সবচেয়ে বড় ১৫-১৬ কেজির ওজনের ১০০ তরমুজ বিক্রি হয় ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকায়।

একেকটির দাম পড়ে ১৯০ থেকৈ ২০০ টাকা। কেজি পড়ে ১৩ থেকে ১৪ টাকা।

দেশের বিভিন্ন চাষির কাছ থেকে পাইকারি ক্রেতারা তরমুজ এনে বিক্রি করেন ঢাকার বাদামতলীর আড়তে।

সোমবার এই আড়তে খুলনা থেকে আসা তিন-চার কেজির প্রতি শ তরমুজ বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকায়। অর্থাৎ একেকটি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। প্রতি কেজির দাম পড়ে ১৮ টাকার কম।

৬ থেকে ৮ কেজির তরমুজের শ বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। একেকটি ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়। এই আকারের তরমুজের দামই সবচেয়ে বেশি। প্রতি কেজির দাম পড়ে ১৭ থেকে ২০ টাকা।

১০ থেকে ১২ কেজির তরমুজ বিক্রি হয়েছে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকায়। একেকটির দাম পড়ে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়। প্রতি কেজির দাম পড়ে ১৫ থেকে ১৭ টাকা।

১৫ কেজির কাছাকাছি ওজনের প্রতি শ তরমুজ বিক্রি হয়েছে ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকায়। একেকটির দাম পড়ে ২২০ থেকে ২২৩ টাকা। প্রতি কেজির দাম পড়ে ১৫ টাকার কিছু বেশি।

খুচরায় দাম কত?

খুচরা ব্যবসায়ীরা যে দামে তরমুজ কেনেন, বিক্রি করেন তার আড়াই থেকে তিন গুণ দামে। সারা দিনের খরচ বাদ দিলেও তারা আইনবিরুদ্ধ মুনাফা করছেন।

বাদামতলী থেকেই এই তরজুম ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বিক্রেতারা পাইকারিতে কিনে নিয়ে খুচরায় বিক্রি করেন। গতকাল খুচরা বাজারে প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হয়েছে কমপক্ষে ৫০ টাকায়।

চার থেকে পাঁচ কেজির তরমুজ কিনতে গেলে খরচ হচ্ছে কমপক্ষে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা।

ফার্মগেটের ভ্যানে করে তরমুজ বিক্রি করছিলেন আরিফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘আগে বেশি দামে বেচছি, এখন একদাম ৫০ টাকা। মানুষ কিনেও কম।’

আরেক বিক্রেতা মো. রাসেল জানান, কেজি বা আস্ত, দাম প্রায় একই, যে যেমন ভালো বুঝে নেয়।

আইন অনুযায়ী দাম হওয়ার কথা ৩০ টাকার নিচে

কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, প্রতি কেজি ফলে মুনাফা করা যায় ১০ টাকা। তবে তরমুজের ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনায় বলা আছে, তরমুজে কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকার বেশি লাভ করা যাবে না।

পাইকারি আড়তে তরমুজের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে থাকায় এই বিধান অনুযায়ী কেজি দরে বিক্রি করলেও দাম পড়ত ২৫ টাকার মধ্যে। আর শহরের ভেতর পরিবহন খরচ ও অপচয় ধরলেও দাম পড়ত ৩০ টাকার ভেতর।

তবে এই বাড়তি মুনাফার বদলে আলোচনা বেশি হচ্ছে কেজিতে বিক্রি নাকি পিস হিসেবে বিক্রি।

কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ অনুযায়ী পাইকারিতে কোনো ফল পিস হিসেবে কিনলে খুচরাতেও বিক্রি করতে হবে পিসে। আর কেজিতে কিনলে বিক্রি করতে হবে কেজিতে।

অর্থাৎ তরমুজের ক্ষেত্রে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে দুই জায়গায়।

পরিবহন খরচ কত?

চাষিদের কাছ থেকে তরমুজ এনে ঢাকার বাদামতলীতে বিক্রি করেন পাইকারি ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্ষেত থেকে তরমুজ আনলাম আর বেচলাম এমন নয়। মৌসুমের শুরুতেই ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা দিয়ে রাখছি মাঠে (চাষিদের দাদন দিয়ে)। পাকনা তরমুজ ক্ষেত থেকে ট্রাকে করে শহরে আনতে হয়, তারপর ট্রাকে করে ঢাকায় আসে। পথে অনেক তরমুজ নষ্টও হয়। ৫০ লাখ টাকা পুঁজি দিয়া যদি কিছু লাভ না করি, খামু কী?’

ব্যবসায়ীরা জানান, তরমুজ ঢাকায় আড়ত পর্যন্ত আনতে তিন স্তরে প্রতিটির পেছনে খরচ পড়ে ৬ টাকার মতো। প্রতিটি ট্রাকের ভাড়া পড়ে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।

ট্রাকের চেয়ে তিন গুণ বেশি খরচ হয় ট্রলারে করে আনলে। ঘাটে বা আড়তে লোড-আনলোডে খরচ রয়েছে। আর নদ বা সড়ক দুই পথেই বিভিন্ন জায়গায় ২ থেকে ৪ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয় ট্রাক ও ট্রলারপিছু।

আড়ত থেকে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে তরমুজ নিতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে গাড়ি ভাড়া করেন। এতে তাদের খরচ কম পড়ে। কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকার মধ্যে থাকে ভাড়া। তবে পরিবহনের সময় কয়েকটা তরমুজ নষ্ট হয়।

চাষির মুনাফা কত?

খুলনার বটিয়াঘাটার দেবীতলার চাষি দীপক মণ্ডল চলতি বছর চাষ করছেন ছয় বিঘা জমিতে। খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকার বেশি।

তিনি জানান, অন্য ফলের চেয়ে তরমুজের খাটনি খুবই বেশি। বেশ কয়েক দফায় সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। আবার বিক্রির সময় থাকে মাত্র ১৫ দিন। এর বেশি হলে ফল পচে যাবে। তাই বেপারিদের সঙ্গে দামদর সেভাবে করার সুযোগ থাকে না।

বেশির ভাগ চাষিই পাইকার বা মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে তরমুজ চাষ করেন। এতে আগে থেকেই পাইকারের কাছে তরমুজ বিক্রির চুক্তি থাকে। তারা যা দাম দেয় তাই নিতে হয়, চাইলেও অন্য কোনো পাইকারের কাছে যাওয়া যায় না। আবার মহাজনরা জোট বেঁধেও তরমুজের দাম কমিয়ে দেন।

বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাটের চাষি শওকত মিয়া বলেন, ‘অনেক পাইকার কয়, ক্যারিং খরচ বেশি। কিন্তু এটা পুরাই মিথ্যা। অনেক চাষিই আড়ত পর্যন্ত তরমুজ দিয়া আয়ে। আমরা চাষিরা এত দামে তরমুজ বেচি না। কেন যে এমন সিন্ডিকেট করছে এরা বুঝি না।’

মাঠপর্যায়ে দাম না পেয়ে খুলনার দাকোপের চাষি পার্থ রায় নিজেই তরমুজ নিয়ে ঢাকায় আসেন। তবে ঢাকায়ও তিনি প্রত্যাশিত দাম পাননি।

তিনি এ বছর ১৬ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে মাঠে দাম কম। তাই তরমুজ নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন।

বলেন, ‘ঢাকায়ও দাম কম। তবে সব খরচ দিয়েও মাঠের চেয়ে ৫০ হাজার টাকা বেশি দাম পাইছি। আর ঢাকায় আনন যাইব না, কুষ্টিয়ায় নিতে ওইব।’

খুলনার দেবীতলার চাষি গোবিন্দ রায় এ বছর ৯ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। ফলন কিছুটা কম হলেও দাম ভালো থাকায় ভালো লাভ হবে।

তবে আগের চেয়ে দাম কমেছে। প্রথম দিকে বিঘাপ্রতি বিক্রি হয়েছে দেড় লাখ টাকা, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে এক লাখ টাকা।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ব্যাপারি দুলাল শিকদার বলেন, ‘আগে বেশি দামে কেনা হইছে, এখন দাম কমায় ব্যাপারিগো লস। এবার ক্যারিং খরচ অনেক বেশি। খ্যাতের থেকে লেবার। লেবার দিয়া পিআপ উঠাইতে হয় এর ঘাটে আইনা বোটে আনতে হয়। এর বোট থেকে আইনা এই বড় গাড়ি লোড করতে হয়। অনেক কেরিং খরচা বাড়ে যাইতেছে। আমরা এখন বর্তমানে খ্যাত কিনতাছি না।’

অভিযানে কিছুটা কমছে দাম

রোজার শুরুতে যে দাম ছিল তরমুজের তার থেকে এখন কিছুটা কমেছে। আগের চেয়ে কেজিতে অন্তত ১০ থেকে ১৫ টাকা কমে পাচ্ছেন ক্রেতারা। খুচরা বাজারে যে তরমুজ গত সপ্তাহে ছিল ৬৫ টাকা কেজি। এখন তা ৫০ টাকায় নেমেছে।

আড়তদাররা জানান, আগের চেয়ে আড়তেই শতে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দাম কমেছে। এক সপ্তাহ আগেও তরমুজের শ ছিল ৮ হাজার টাকার ওপরে। এখন তা সাড়ে ৬ থেকে ৭ হাজারেও নেমেছে।

মাদারীপুরের ব্যাপারি গিয়াস কাজি বলেন, ‘পেপার-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করতাছে এই সমস্যার কারণে।’

তিনি বলেন, ‘বিঘাপ্রতি তরমুজ ব্যাপারিরা যে যা বায়না দিছে তা থুয়ে চলে যাচ্ছে, মাল নিচ্ছে না। দাম কম, মোকামে অর্ধেক দাম। যেটা ছিল তিন শ সেটা এখন দেড় শ। এতে কৃষক আর ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

উৎপাদন ব্যাপক

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এ বছর দেশে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি গড়ে ৫০ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদন হচ্ছে। যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বেশি।

গত কয়েক বছরে গড় বার্ষিক উৎপাদন ২১ থেকে ২২ লাখ টন।

মোট আবাদের প্রায় ৬২ শতাংশ হয়েছে বরিশাল বিভাগে। এরপরই খুলনা। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকাসহ অন্যান্য এলকায়ও কিছু আবাদ হয়।

চলতি মৌসুমে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ২৪ হাজার ৪৮১ হেক্টর জমিতে তরমুজ উৎপাদন হয়েছে। আর খুলনায় প্রায় ৭ হাজার ৫১২ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের তরমুজের আবাদ হয়েছে।

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘গত বছর তরমুজ চাষ করে লাভবান হয়েছিলেন চাষিরা। এবার তাই আবাদও বেশি করেছেন। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে এই তরমুজ তৈরি করেন কৃষকরা। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএডিসিও ৩০ কিলোমিটার খাল খননের প্রকল্প নিয়েছে। পানি থাকলে তরমুজের ফলন বেশি হয়।’

এ বিভাগের আরো খবর