খুচরা পর্যায়ে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৫৭ টাকা করার আবদার জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে চিঠি দিয়ে আরেক দফা দাম বৃদ্ধির এই আবদার করেছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের কাছে গত ২৭ এপ্রিল চিঠি দিয়ে নতুন দামের প্রস্তাব করেছে ব্যবসায়ীদের এই সংগঠন।
চিঠিতে বলা হয়, আগামী ১৭ মে থেকে নতুন এই দাম কার্যকর হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে লাগামহীন দাম, তাই এ ছাড়া উপায় নেই।
নতুন দাম প্রস্তাব
নতুন যে দামের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে তেল কিনতেই হিমশিম খাবেন ক্রেতারা।
চিঠিতে বলা হয়, এক লিটার লুজ সয়াবিন তেলের মিলগেট মূল্য হবে ১৩০ টাকা। পরিবেশ মূল্য ১৩২ এবং খুচরা দাম হবে ১৩৪ টাকা।
তবে, এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের মিলগেট মূল্য প্রস্তাব করা হয়েছে ১৪৬ টাকা। পরিবেশক মূল্য ১৫১ টাকা। আর খুচরা মূল্য হবে ১৫৭ টাকা।
আর পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের মিলগেট মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০৫ টাকা, পরিবেশক মূল্য ৭২৫ টাকা। আর খুচরা মূল্য ৭৪৫ টাকা।
পাম তেলের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবও দিয়েছে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠন।
বলা হয়, এক লিটার পাম তেলের মিলগেট মূল্য ১২০ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১২২ টাকা এবং খুচরা মূল্য হবে ১২৪ টাকা।
দফায় দফায় মূল্য নির্ধারণ
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক বিষয়ক জাতীয় কমিটি গত ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো ভোজ্যতেলের দর নির্ধারণ করে। সে সময় প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১১৫ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন ১৩৫ টাকা ও পামঅয়েল ১০৪ টাকায় বিক্রির জন্য নির্ধারণ করা হয়।
এর পর ১৫ মার্চ জাতীয় কমিটি এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৩৯ টাকা, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ৬৬০ টাকা, খোলা সয়াবিন ১১৭ টাকা ও পামওয়েল ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয়।
পরে ১৯ এপ্রিল ট্যারিফ কমিশনকে চিঠি দিয়ে প্রতি লিটারে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করে দেশে ভোজ্যতেল উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। এই দাম বৃদ্ধিতে সরকারের কোনো সম্মতি ছিল না। ব্যবসায়ীরা চিঠি দিয়েই কার্যকর করে দাম।
নতুন দর অনুযায়ী, এখন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১২২ টাকা, এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ১৪৪ টাকা ও পাঁচ লিটারের বোতল ৬৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি লিটার পাম সুপার তেল ১১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে
শুভঙ্করের ফাঁকি
লিটারে ৫ টাকা ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে আবার সেই বাড়তি দাম থেকে তিন টাকা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে তেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন। সোমবার এক চিঠিতে জানানো হয়, পবিত্র রমজান এবং করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে লিটারে তিন টাকা কমানো হলো।
তবে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের চিঠিতে বর্তমান মূল্য কত তা স্পষ্ট করা হয়নি। চিঠিতে আরও বলা হয়, বিশ্ব বাজারে দামের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে লিটারে দাম ৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। বৃদ্ধি করে কত নির্ধারণ করা হয়, তা বলা হয়নি।
তবে, বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেল ১৩৯ টাকা নির্ধারিত দাম থেকে ৫ টাকা বাড়িয়ে করা হয় হয় ১৪৪ টাকা। সেখান থেকে ৩ টাকা কমিয়ে এখন নতুন দাম বলা হচ্ছে ১৪১ টাকা। অর্থাৎ আগের দামের চেয়েও যা ২ টাকা বেশি।
টালমাটাল বিশ্ব বাজার
কয়েক মাস ধরে টালমাটাল তেলের বিশ্ব বাজার। বাংলাদেশ মূলত দুটি দেশ থেকেই সিংহ ভাগ ক্রুড (অপরিশোধিত) তেল আমদানি করে থাকে। দেশ দুটি হচ্ছে মালয়েশিয়া ও ব্রাজিল।
ট্যারিফ কমিশনের মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্রাজিলে এখন প্রতি টন অপরিশোধিত তেলের দাম ১ হাজার ৩৩১ ডলার। এক মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৭৪ ভাগ।
আর মালয়েশিয়ায় প্রতি টন অপরিশোধিত পামওয়েলের দাম ১ হাজার ৯০ ডলার।
পামওয়েলের দাম মাসে বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৬২ ভাগ। এই দামে ক্রুড তেল আমদানি করে বিক্রি করতে গেলে বেড়ে যাচ্ছে দাম।
অগ্রিম কর প্রত্যাহারে সুফল নেই
দামের লাগাম টানতে আমদানি করা অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পামওয়েলের ওপর ৪ শতাংশ অগ্রিম কর প্রত্যাহার করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এনবিআর।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে প্রস্তাবসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়। সেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামওয়েল আমদানিতে আরোপিত কর ও ভ্যাট যৌক্তিক হারে নির্ধারণের জন্য এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
অগ্রিম কর প্রত্যাহারের পরও তার সুফল মিলছে না। দামের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাবই পড়েনি। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে দাম।
ট্যারিফ কমিশনের একজন কর্মকর্তা জানান, পরিবেশক আইনে বলা আছে, দাম বাড়াতে হলে সরকারের কাছে যৌক্তিক প্রস্তাব দিতে হবে। বিবেচনা করেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সিদ্ধান্ত দেয়ার আগেই বাজারে নতুন দাম কার্যকর হচ্ছে। বলা হয়, বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু সেই তেল দেশে কখন কতটুকু আসছে তার হিসাবও যাচাই করতে হবে।
কনজ্যুমার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করা গেলে এই সংকটের সময় মানুষের কষ্ট বাড়বে। দাম বাড়লে তা কীভাবে ভর্তুকি দামে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানো যায়, তার উপায় বের করতে হবে।