করোনাভাইরাস মহামারির প্রথম ঢেউয়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার সোয়া লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করেছিল, তার মধ্যে বড় উদ্যোক্তাদের জন্য ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর অর্ধেক, অর্থাৎ ২০ হাজার কোটি টাকাই পেয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা।
এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় ফের ওলটপালট বাংলাদেশের অর্থনীতি। আর এ ধাক্কা সামাল দিতে সরকারের কাছে নতুন প্রণোদনা চেয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। এবার শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন-ভাতা দিতে টাকা চেয়েছেন তারা। প্রথম প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নিয়ে চার মাসের বেতন-ভাতা দিয়েছিলেন এই শিল্পমালিকেরা।
নতুন প্রণোদনার ব্যাপারে সরকার এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, বিষয়টি বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেলেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
পোশাকশিল্পের মালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেছেন, ‘চলতি সপ্তাহের মধ্যেই সরকার আমাদের আবেদনের ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দেবে বলে আশা করছি।’
গত বছরের মার্চে দেশে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর মোট ২৩টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ২৪ হাজার ১০০ কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে বড় উদ্যোক্তাদের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকার পাশাপাশি ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য ছিল ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ। এর মধ্যে বড়দের ঋণের পুরোটা অনেক আগে শেষ হয়ে গেলেও ছয় দফা মেয়াদ বাড়িয়েও ছোট ঋণ বিতরণ শেষ হয়নি।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রণোদনার সিংহভাগই পেয়েছেন এই পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, বড় উদ্যোক্তাদের ৪০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন ৩ হাজার ১২৯ জন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিক। এর মধ্যে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা তারা নিয়েছেন শ্রমিকদের বেতন দেয়ার জন্য। বাকিটা নিয়েছেন ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে।
তবে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ বাস্তবায়ন মোটেও সন্তোষজনক নয়।কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতে করোনার ক্ষতি পোষাতে সরকার গত বছরের এপ্রিলে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করে। প্রথমে আগস্টের মধ্যে পুরো ঋণ বিতরণ শেষ করতে বলা হয়। পরে পাঁচ দফা সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের মার্চের মধ্যে বিতরণ শেষ করতে বলা হয়। তবে এ পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা।
গত এপ্রিলের মাঝামাঝিতে এ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ শেষ করার সময়সীমা ষষ্ঠবারের মতো বাড়িয়ে জুন পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে।
গত বছরের একই সময়ে বড় শিল্পের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করে সরকার। ব্যাপক চাহিদার কারণে এর পরিমাণ বাড়িয়ে প্রথমে ৩৩ হাজার কোটি টাকা, পরে আরও ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। দুটি তহবিল থেকেই ব্যাংকগুলো বর্তমানে নির্ধারিত ৯ শতাংশ সুদ পাচ্ছে। এর মধ্যে সিএমএসএমই খাতে সরকার ৫ শতাংশ এবং বড় উদ্যোক্তাদের ঋণে সাড়ে ৪ শতাংশ ভর্তুকি দেবে।
প্রথম দফায় পোশাকশ্রমিকদের বেতনের জন্য সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার যে ঋণ দেয়া হয়েছে, তার সার্ভিস চার্জ মাত্র ২ শতাংশ।
ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সিএমএসএমই খাত পিছিয়ে থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্যতম ভূমিকা রাখছে এ খাত। সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের তথ্য অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে এসএমই খাতের মাধ্যমে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সমীক্ষা অনুসারে, দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে।করোনাভাইরাসে ক্ষতির প্রভাব নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে ৫ শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর একটি জরিপ করে বিশ্বব্যাংকের আইএফসি এবং যুক্তরাজ্যের এফসিডিও। এতে দেখা যায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ৯১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান নগদ প্রবাহের সংকটে পড়েছে। এ খাতের ৯৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের বিক্রি ব্যাপক কমেছে। ৩৭ শতাংশ শ্রমিক স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে কাজ হারিয়েছে। সিএমএসএমই খাতে এমন খারাপ অবস্থা দেখা দিলেও ঋণ বিতরণে পুরোনো পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ না পাওয়ার অভিযোগ অনেক পুরোনো। করোনার এ সময়ে তা আরও বেশি শোনা যাচ্ছে। হয়রানি ও কালক্ষেপণ ছাড়া এসব উদ্যোক্তাকে ঋণ দিয়ে এগিয়ে নিতে পারলে উৎপাদন এবং চাহিদা আরও বাড়বে। ছোট একটি উদ্যোগে পাঁচজনের কর্মসংস্থান হলেও তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়।
তিনি বলেন, ‘সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে যেসব ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি, তাদের ধরে ধরে চিঠি দিতে হবে। এরপরও অর্জন না হলে নতুন শাখার অনুমোদন কমানোসহ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সুযোগসুবিধা কমাতে হবে। ছোটরা না এগোলে শুধু বড়দের দিয়ে অর্থনীতির পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়।’বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, করোনার কারণে গত বছরের রোজা, দুই ঈদ ও পয়লা বৈশাখের ব্যবসা হয়নি। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এবারও একই অবস্থা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিপণিবিতান খোলা থাকলেও ক্রেতা কম।
‘সরকারি সহায়তা ছাড়া এই বিপদ কাটিয়ে ওঠা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সারা দেশের দোকান মালিকদের জন্য কম সুদে আলাদা ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দ্বিতীয় ঢেউ নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে। নতুন প্রণোদনা নিয়ে ভাবতে হবে দ্রুত। এবার অবশ্যই ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের দিকে বেশি নজর দিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে বড় ভূমিকা সিএমএসএমই খাতের। প্রতিটি ব্যাংকের মোট ঋণের ২৫ শতাংশ এ খাতে বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। এরপরও একজনকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে বেশি মুনাফা করার মানসিকতা থেকে ব্যাংক এখনও বের হতে পারেনি। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ না পাওয়ার অভিযোগ শুনতে হচ্ছে।’
আবার টাকা চান পোশাকশিল্পের মালিকেরা
শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে সরকারের কাছে আবার টাকা চেয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা।
ঈদের আগে আর্থিক সংকটের কথা বলে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও বোনাস দিতে এ টাকা চেয়েছেন তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা।
গতবারের মতো একই শর্তে এপ্রিল, মে ও জুন—এই তিন মাসের বেতন-ভাতা ও বোনাস দেয়ার জন্য ঋণ চেয়েছেন তারা।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান এবং বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন গত ২৫ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে চিঠি দিয়ে ঋণ দেয়ার অনুরোধ করেছেন।
চিঠির অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবরও পাঠানো হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বর্তমানে পোশাক রপ্তানির অর্থ সময়মতো দিচ্ছে না অনেক ক্রেতা। তারা ৬০ থেকে ১৮০ দিন পর্যন্ত সময় চাইছে। এ ছাড়া অনেক ক্রেতাকে মূল্যছাড়ও দিতে হচ্ছে।
‘আবার ঈদের আগে বেতন-ভাতা ও ঈদ বোনাস দিতে অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ কারখানা মালিকের হাতেই পর্যাপ্ত অর্থ নেই। সে কারণে আমরা সরকারের কাছে ঋণ চেয়েছি।’
করোনার কারণে গত বছর মার্চে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশ আসতে থাকে। তখন পোশাকশিল্পের মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রপ্তানিমুখী শ্রমিকদের এপ্রিল, মে ও জুন—তিন মাসের মজুরি দেয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে।
এই ঋণের বিপরীতে সেবা মাশুল ছিল ২ শতাংশ। পরে পোশাকশিল্পের মালিকেরা আরও এক মাসের মজুরি দেয়ার জন্য ঋণ দাবি করেন। সরকারও মেনে নেয়।
তখন তহবিলের আকার বেড়ে ৯ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা দাঁড়ায়। তবে চতুর্থ মাসের জন্য ঋণের মালিকদের সুদ দিতে হবে সাড়ে ৪ শতাংশ। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ ভর্তুকি দেবে সরকার।